মৌলভীবাজারে পর্যটন শিল্পে ক্ষতি ১০ কোটি

প্রকাশিত: ২:২৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০২০

মৌলভীবাজারে পর্যটন শিল্পে ক্ষতি ১০ কোটি

  মোতাহার হোসেন  মৌলভীবাজার ঃ  করোনাকালীন সময়ে পর্যটননগরীর মৌলভীবাজার জেলায় দর্শনীয় স্থানগুলো পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে। করোনার প্রভাবে হোটেল-মোটেল, গেস্টসহ আবাসিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যার ফলে জেলায় পর্যটক আসছে না এখন।

হোটেল-মোটেল খোলার জন্য জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা না আসায় অধিকাংশই বন্ধ রয়েছে। করোনাকালীন প্রায় চার মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। এখন সরকারী বিধিনিষেধ শিথিল হলেও পর্যটক না আসায় অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। তবে এই অবস্থা বিরাজ করলে আরও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে তারা মনে করছেন।

জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অধিকাংশই হোটেল ও রিসোর্ট এবং পর্যটন স্থান হিসাবে বিশ^ব্যাপী পরিচিত। যেখানে রয়েছে প্রায় ১০০-১৫০ হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস রিসোর্ট ও কটেজ। তারমধ্যে দুইটি ফাইভ স্টার হোটেল এবং ৫টির বেশি রয়েছে থ্রি স্টার মানের হোটেল রিসোর্ট।

এদিকে এখন পর্যটনের ভরা মৌসুম। অন্যান্য বছর এই সময়ে পর্যটককে ভরা থাকলেও, এবারের চিত্র ভিন্ন। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে জেলায় দেশি ও বিদেশী পর্যটক শূন্য।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, বীর শ্রেষ্ট হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, টি বোর্ডের অধীনে শ্রীমঙ্গল বিটিআরআই চা বাগান, বধ্যভূমি ৭১, সাত লেয়ারের চা, বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন, বাইক্কা বিল হাইল হাওর, মাধবকুন্ড জল প্রপাত, হাকালুকি হাওরসহ ইত্যাদি দর্শনীয় স্থানে পর্যটককের দেখা নেই। করোনার প্রভাবে অথনৈতিক মন্দা থাকায় প্রায় মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পর্যটন সেক্টরে ধ্বস নেমেছে।

এছাড়াও জেলার সদর উপজেলার মোকামবাজার এলাকায় অবস্থিত অভিজাত হোটেল দুসাই রির্সোট, শ্রীমঙ্গল উপজেলার গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ, টি বোর্ডের নিয়ন্ত্রনধীন টি রিসোর্ট, লেমন গার্ডেন, নভেম রিসোর্ট, টি হ্যাভেন রিসোর্ট, বালিশিরা ভ্যালীসহ অধিকাংশই হোটেল ও মোটেল বন্ধ রয়েছে। তারমধ্যে লোকসানে গুনতে গিয়ে জেলার ভানুগাছ এলাকায় “লাউয়াছড়া ইকো কটেজ” বন্ধ করে দিয়েছে মালিক পক্ষ। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বছরের মধ্য নভেম্বর থেকে জুলাই আগস্ট পর্যন্ত ভরা পর্যটন মৌসুম।

এসময়ে পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। প্রতিদিনই বেড়াতে আসে অন্তত ১০ হাজারেরও বেশী পর্যটক। কিন্তু গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া রোগী শনাক্তের পর থেকে ভরা মৌসুমেও জেলায় বেড়াতে আসা দেশি ও বিদেশি পর্যটকের ভাটা পড়েছে।

শ্রীমঙ্গল ট্যুর অপারেটর রিজভী বলেন, ‘জেলার পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক খাতে এখন আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে। জেলায় সরকারি বে-সরকারি মিলে প্রায় প্রায় ১০০টি হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে, তারমধ্যে বেশির ভাগই হোটেল, রিসোর্ট শ্রীমঙ্গলে। এর ওপর নির্ভরশীল কয়েকশত মানুষ। তারা এখন বেকার।

পর্যটন খাতের আরেক ব্যবসায়ী ও লাউয়াছড়া ইকো কটেজের সত্বাধিকারী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলায় শুধু হোটেল মোটেল নয়, অধিকাংশই মানুষ কৃষিপণ্যের ব্যবসা, চা ব্যবসাও পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। পর্যটকরাই শ্রীমঙ্গলের লেবু, আনারস, চা ও মনিপুরী শাড়িসহ হাতে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী বড় ক্রেতা বলে জানান তিনি।’

শ্রীমঙ্গল ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খালেদ আহমদ বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা ট্যুর অপারেট ও ট্যুর গাইড মিলে প্রায় ৪৭ জনের রয়েছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ২১ জন শুধু এ কাজই করেন। ট্যুরিজম বোর্ড থেকে কিছু প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।’

শ্রীমঙ্গল রাধানগরে অবস্থিত গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফ-এর সহকারী জেনারেল ম্যানেজার আরমান খাঁন বলেন, করোনার কারণে পর্যটনখাতে ক্ষতি কোটি টাকার ওপরে ছাড়িয়ে গেছে। একই কথা বলেন লেমন গার্ডেনের পরিচালক সেলিম আহমদ। তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসায় নেমে এখন হতাশ।

শ্রীমঙ্গলের ব্যবসায়ী মো.শাহেদ আহমদ বলেন, এ এলাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ীই চা, কৃষি ও পর্যটন নির্ভর। খাবার হোটেল থেকে শুরু করে মিষ্টির দোকান রয়েছে। কারণ পর্যটক না থাকলে ব্যবসাও থাকে না।’

তিনি আরও বলেন, হোটেল বন্ধ থাকলে কৃষি দ্রব্য ও চা সরবরাহকারীদের ব্যবসাও বন্ধ থাকে। মুরগি ব্যবসায়ী, মাংস ব্যবসায়ী, মাছ ব্যবসায়ী, চাল ব্যবসায়ী, মুদি দোকানিসহ আরও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

মৌলভীবাজার জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন শ্রীমঙ্গল উপজেলা সভাপতি ময়না মিয়া বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ১ হাজার ৩৭০ জন নিবন্ধিত শ্রমিক আছেন, তার মধ্যে ৬০০-৭০০ জন কার, মাইক্রোবাস, জিপ বা অন্য বাহনের চালক পর্যটন খাতে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এতদিন যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। এখন বিধিনিষেধ শিথিল হলেও পর্যটক না আসায় তাদের অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না।’

শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সীতেশ রঞ্জণ দেব বলেন, চারমাস ধরে প্রায় ৫-৬ লাখ টাকার পশুখাদ্য ও কর্মচারী বেতন দিয়ে যাচ্ছি। সরকারীভাবে কোন প্রণোদনা পাইনি। প্রতিদিন ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আর টিকে থাকতো পারবো না।

মৌলভীবাজারের নবাগত জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, ‘এ জেলায় আমি ২১তম জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেছি। মৌলভীবাজার জেলা আসলে এটি একটি পর্যটন শিল্প। জেলায় প্রবেশ করি তখন চারপাশে চা বাগান গুলো দেখে মনে হচ্ছে সবুজের অবারিত মাঠ। আমি “সবুজ সমুদ্র” হিসেবে নাম দিতে পারি। কক্সবাজারকে যেমন বলা হয় “নীল সমুদ্র” তেমনি মৌলভীবাজার হচ্ছে “সবুজ সমুদ্র”। এখানে পর্যটননির্ভর লোকের সংখ্যাও বেশি। লকডাউনের কারণে ক্ষতির মুখে পড়া পর্যটন সংশ্লিষ্টদের সহায়তার বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন দপ্তরে অবহিত করা হবে। কুয়াকাটা খোলা হয়েছে আর সরকারের নির্দেশনা পেলে মৌলভীবাজার জেলায় হোটেল ও মোটেল খোলার নির্দেশনা দেয়া হবে।”

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ