সিলেট ২রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫
লেখক: জীম হামযাহ
জুলাই-আগস্টে শত শত লাশ ফেলে, হাজার হাজার মানুষকে আহত-পঙ্গু করে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গেলেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি আওয়ামী লীগ। এমনকি এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো অনুতাপ-অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে না।
বরং প্রচণ্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আবারও ফিরে আসার সুযোগ খুঁজছে। ক্ষমতা হারানোর পর তারা নানা কায়দায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে। তারা বিস্তার করছে একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল। নানা বেশে মাঠে ফেরার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হলেও উদ্যম হারায়নি। আর এক্ষেত্রে তাদের মিত্র ভারতকেও ব্যবহার করছে, লগ্নি করছে সেখানকার মিডিয়ার পেছনেও। বলতে গেলে আওয়ামী লীগ এখন নানা ফ্রন্টে খেলে যাচ্ছে। একটার পর একটা কার্ড ছাড়ছে। নানাভাবে ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে তারা। আর এরই মধ্যে সক্রিয় হয়েছে আওয়ামী লীগের সফট পাওয়ার শক্তিগুলো। আওয়ামী লীগের এই সফট পাওয়ার তথা আওয়ামীপন্থি গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন প্রচারযন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র বটে। ৫ আগস্টের পর এই সফট পাওয়ারের মোড়ক কিছুটা নষ্ট হলেও মূল কাঠামো রয়েছে এখনো অক্ষত। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু খোলস পাল্টেছে মাত্র।
আওয়ামী লীগ যখনই বিপদে পড়েছে, তখনই আওয়ামী লীগের সফট পাওয়ার সক্রিয় হয়ে তাদের উদ্ধার করেছে। তা না হলে পৃথিবীর অনেক দেশের মতো স্বৈরাচারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি। যখনই আওয়ামী লীগের পতন ঘটে, তখনই পরিস্থিতি বুঝে আওয়ামী লীগের এই সফট পাওয়ার তাদের ফিরে আসার বৈধতা বা ন্যায্যতা দাঁড় করিয়ে দেয়। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একটা গ্রহণযোগ্যতা বা প্রয়োজন পরোক্ষভাবে যৌক্তিক করার চেষ্টা করে। এভাবে আওয়ামী লীগ যতবার বিপদে পড়ে, আওয়ামী লীগের সফট পাওয়ার তাদের উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসে। এরা আওয়ামী লীগের সুসময় ও দুঃসময় উভয় সময়ই পাশে থাকে। গত ১৬ বছর তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে নানাভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে বয়ান তৈরি করেছে এবং তাদের অবৈধ শাসনক্ষমতার ন্যায্যতা প্রদান করেছে। তারা বুঝিয়েছে, “ভুলভ্রান্তি একটু থাকলেও বাংলাদেশের জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি’ আওয়ামী লীগই একমাত্র ত্রাতা, একমাত্র আওয়ামী লীগের হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে। বিএনপি-জামায়াত এলে বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে যাবে, পাকিস্তান হয়ে যাবে ইত্যাকার কথা। আওয়ামী লীগের হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ।” তারা জনমানসে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বাংলাদেশের জন্য আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই।
৫ আগস্টের পর তারা খানিক নীরব থাকলেও কৌশলে আবারও সরব হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা চিহ্নিত করে এই সরকারকে কীভাবে দ্রুত অজনপ্রিয় করে তোলা যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে রীতিমতো। এখন বাংলাদেশ যেভাবে চলছে, তার চেয়ে আওয়ামী সময়টাই ভালো ছিল বা আগেই ভালো ছিলাম, এমন একটা মনোভাব দাঁড় করাতে তারা বেশ সক্রিয়। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীরা খুবই সক্রিয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে মাঠে সরব হতে শুরু করেছে কথিত অনেক সাংবাদিক। এরই মধ্যে তারা সমন্বয়ক বা ছাত্র নেতৃত্বকে নানাভাবে বিতর্কিত করার মাধ্যমে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নানা বয়ান হাজির করছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও ইউনূস সরকারের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের কার্যক্রম থেমে নেই। নানাভাবে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বীজ বপন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এসবের ফলাফলও এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। তারা অপ্রাসঙ্গিকভাবে ’৫২, ’৭১ এসব টেনে এনে ’৭১ আর ’২৪-এর মধ্যে একটা বিরোধ সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। আবারও তারা হাজির করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আওয়ামী বয়ান। ’২৪-এর অভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তি বলে তারা একটা বিরোধ লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করতে সচেষ্ট। তারা চাচ্ছে আওয়ামী লীগের ওপর থেকে ’২৪-এর গণহত্যার কলঙ্ক হালকা করতে এবং আওয়ামী লীগ যে ভুল পথে ছিল না, সেটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে তারা। আওয়ামী লীগের এই সফট পাওয়ার চাচ্ছে সমন্বয়ক বা ছাত্র নেতৃত্বকে যেভাবে হোক বিতর্কিত বা সমালোচিত করে জুলাইয়ের অভ্যুত্থানটাকে প্রশ্নবিদ্ধ বা যতটা সম্ভব গুরুত্বহীন করে দিতে। আর তাতে আওয়ামী লীগ অনেকটা দায়মুক্ত হয়ে যাবে।
জুলাই অভ্যুত্থানে মশাল যত দীপ্যমান থাকবে, আওয়ামী লীগ মুখ লুকাতে পারবে না বা তাদের ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ আড়াল করতে পারবে না। আওয়ামী লীগের পক্ষে ’২৪-কে হজম করা অসাধ্য। তাই যেভাবে হোক ’২৪-কে বিতর্কিত বা কলঙ্কিত করতে পারলে তারা বাঁচে। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে যে একটা জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে, সেটা আওয়ামী লীগের জন্য অসহ্যকর। তারা নানা বিতর্ক হাজির করে আওয়ামী ফ্যাসিস্টবিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরাতে চাচ্ছে। এটা করতে পারলে প্রতিশোধপরায়ণ আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পথও অনেকটা সুগম হয়ে যায়। এরই মধ্যে তাদের এই সূক্ষ্ম ফাঁদে পা দিয়েছে অনেকে। জাতীয় ঐক্যে এরই মধ্যে তারা বিভেদ লাগিয়ে দিয়েছে। অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এরই মধ্যে সে ঐক্যেও অনেকটা চিড় ধরেছে। ছাত্রদের যে ঐক্যবদ্ধ শক্তি সেখানেও ফাটল ধরেছে। নিজেরাই এখন জড়িয়ে যাচ্ছে নানা কোন্দলে। অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনাবশ্যক বিতর্কের অবতারণা ঘটছে। অনেক রাজনৈতিক নেতার কথাবার্তা ও সুর আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক হয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাদের টোন আর আওয়ামী লীগের টোন আলাদা করা যাচ্ছে না সম্প্রতি। বিএনপিরও এমন কিছু কথাবার্তা ও সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগ বেশ সমর্থন ও সহমত জানিয়ে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। নানা অপ্রাসঙ্গিক ও অনাবশ্যক ইস্যুর অবতারণায় বিনষ্ট হচ্ছে জাতীয় ঐক্য।
বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বোঝা যায় এটা অনেকটা আওয়ামী লীগের সফট পাওয়ারের নেপথ্য শক্তি। আওয়ামী লীগ নিষ্ক্রিয় নয়। নানাভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত। কৌশল বদলাচ্ছে বারবার।
আওয়ামী লীগের এই সফট পাওয়ার এককভাবে চিহ্নিত করা খুব মুশকিল। এটা নানা উয়িংয়ে বিভক্ত হয়ে আছে। গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক সংগঠন, আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি কর্মী, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টসহ সুশীল-বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছেন সফট পাওয়ারের জোগানদাতা। এই সফট পাওয়ারের মধ্যে বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক লবিস্টরাও আছেন। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের মধ্যেও আওয়ামী লীগের সফট পাওয়ার রয়েছে। আওয়ামী লীগকে যারা সফট পাওয়ারের জোগান দেন, তাদের কারও গায়ে আওয়ামী লীগ লেখা থাকে না, বা তারাও বলেন না, তারা আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারা সবসময় আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্মতি ও সহানুভূতি উৎপাদনে কাজ করেন। এই সফট পাওয়ার হচ্ছে আওয়ামী লীগের খুবই শক্তিশালী এক হাতিয়ার। রাজনীতিতে এটা ব্যবহারে আওয়ামী লীগ খুবই পারঙ্গম।
লেখক: ঠিকানা-ব্লক-বি, শাহজালাল উপশহর, সিলেট সদর
email : jimhamzah@gmail.com
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ- মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান (ডালিম)
মোবাঃ- 01712-174796
অনলাইন সম্পাদক : জাকারিয়া হোসেন জোসেফ
মোবাঃ- 01711-145909
ইমেইলঃ-newssylbangla@gmail.com
রংমহল টাওয়ার ৪র্থ তলা বন্দর বাজার, সিলেট।
Design and developed by M-W-D