সিলেট ১২ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৫
সেলিম মাহবুব,ছাতক প্রতিনিধি:
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মরমি গীতিকবি বাউলসাধক দুর্বিন শাহ ১৯২০ সালের ২ নভেম্বর (১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১৫ কার্তিক) তৎকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার ছাতক থানার নোয়ারাই গ্রামের তারামনি টিলায় জন্মগ্রহণ করেন। এই তারামনি টিলা কালক্রমে দুর্বিন টিলা নামেই পরিচিতি লাভ করে। গীতি কবিতার জগতে সুপরিচিত এক নাম দুর্বিন শাহ। তার পিতা সফাত আলি শাহ ছিলেন একজন সুফি সাধক এবং মা হাসিনা বানু ছিলেন একজন পীরানী (পীর)। যে কারণে বলা যায় দুর্বিন শাহ সঙ্গীতচর্চার ক্ষেত্রে তার পারিবারিক ঐতিহ্যকে লালন করেছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারান বাউলসাধক দুর্বিন শাহ। ১৯৪৬ সালে সুরুফা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তার রচিত অধিকাংশ গানে সুফি ও মরমিবাদ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠলেও এসবের বাইরে অসংখ্য ভিন্ন ধারার গানও তিনি রচনা করেছেন। শ্রেণি বিভাজন করলে এসব গানকে বাউল, বিচ্ছেদ, আঞ্চলিক, গণসঙ্গীত, মালজোড়া, জারি, সারি, মিলন, ভাটিয়ালি, গোষ্ঠ, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলি, হামদ-নাত, মারফতি, পীর-মুর্শিদ স্মরণ,আল্লাহকে স্মরণ, নবী-রাসুল স্মরণ, ওলি আউলিয়াকে স্মরণ, ভক্তিগীতি, মনঃশিক্ষা, সুফিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেশাত্মবোধক গানসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। ভাটি বাংলা খ্যাত সিলেট-সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা অঞ্চলে বাউল পদাবলি রচয়িতার তালিকা বেশ দীর্ঘ।সে তালিকার শ্রেষ্ঠ পদকর্তাদের মধ্যে দুর্বিন শাহের নাম ততধিক সমুজ্জ্বল। দুর্বিন শাহর গানে দেহতত্ত্ব এবং বাউল-দর্শনের নিগূঢ় বিষয়াবলি গভীরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। তার গানের ভাষা পূর্বসূরি বাউলসাধকদের চেয়ে খানিকটা ব্যতিক্রমী ও বৈচিত্র্যময়। কোরআন-পুরাণ-শরিয়তি-মারফতি বিশ্লেষণের পাশাপাশি দেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে উপজীব্য করে তিনি গানের কাঠামো তৈরি করেছেন। এ কাঠামোর পরতে পরতে রয়েছে নানা রকমের সাঙ্কেতিক ভাষা এবং বাউলদের গোপন তত্ত। তবে এসব তত্তপূর্ণ কথার মাধ্যমে অধ্যাত্মবাদী চেতনাকে ধারণ করে বস্তুবাদী চেতনারই প্রকাশ ঘটেছে। এমনকি জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় হানাহানির বিরুদ্ধে তার গান হয়ে উঠেছে সম্প্রীতি ও চেতনার বাতিঘর। তার গানের অন্যতম অবলম্বন মানবতার জয়গান। বাউল সাধক দুর্বিন শাহকে ‘জ্ঞানের সাগর’ অভিধায় ভূষিত করা হয়ে থাকে। এই অভিধার কারণটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।১৯৬৮ সালে বাউলসাধক দুর্বিন শাহ ও শাহ আবদুল করিম প্রবাসীদের আমন্ত্রণে বিলেত সফরে গিয়ে ছিলেন। সেখানে তারা দুজন গান গেয়ে দর্শক-শ্রোতাদের আপ্লুত করেছিলেন। তাদের গানের কথা ও সুরে মুগ্ধ এবং বিমোহিত হয়ে সঙ্গীতপ্রেমী প্রবাসীরা দুর্বিন শাহকে ‘জ্ঞানের সাগর’ এবং শাহ আবদুল করিমকে ‘রসের সাগর’ অভিধায় অভিষিক্ত করেছিলেন। অতীতে গ্রামীণ মানুষের মধ্যে দুর্বিন শাহের পদাবলি ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করলেও সেগুলো নাগরিক সমাজে ততটা প্রচলিত ছিল না। তবে লক্ষণীয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে দুর্বিন শাহের গানের প্রতি সর্বত্র আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রয়াত এই বাউলের লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গান-‘আমি জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারই চরণে রে’, ‘নির্জন যমুনার কূলে বসিয়া কদম্বতলে’, আমার অন্তরায় আমার কলিজায়’, ‘সুখের নিশি প্রভাত হলো উদয় দিনমণি’’শমন লইয়া পিয়ন খাড়া আর কত দিন দেরি’, ‘ছাড়িয়া যাইও না বন্ধু রে’, ‘কৃপাসিন্ধু দীনবন্ধু নামটি তোমার সংসারে’, ‘পরদেশিরে দূর বিদেশে ঘর’, নব যৌবন আষাঢ় মাসে’, ‘তোমার মতো দরদি কেউ নাই’, ‘বন্ধু যদি হইতো নদীর জল’ ইত্যাদি ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয় গানের রচয়িতা ছিলেন তিনি। প্রকাশিত গানের সঙ্কলনগুলো হচ্ছে প্রেমসাগর পল্লীগীতি প্রথম খণ্ড (১৯৫০),প্রেমসাগর পল্লীগীতি দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৫০), প্রেমসাগর পল্লীগীতি তৃতীয় খণ্ড (১৯৬৮),প্রেমসাগর পল্লী গীতি চতুর্থ খণ্ড (১৯৬৮), পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি (১৯৭০),প্রেমসাগর পল্লীগীতি পঞ্চম খণ্ড (১৯৭৩) ও দুর্বিন শাহ সমগ্র (২০১০)। ১৯৭৪ সালে কলকাতার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক তার যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রে দুর্বিন শাহের একটি গান ব্যবহার করেছিলেন।
‘নামাজ আমার হইল না আদায়’ শীর্ষক এই গানটি এ রকম-নামাজ আমার হইল না আদায়
নামাজ আমি পড়তে পারলাম না, দারুণ খন্নাছের দায়॥
ফজরের নামাজের কালে, ছিলাম আমি ঘুমের ঘোরে
জোহর গেল আইতে-যাইতে, আছর গেল কামের দায়॥
মাগরিবের নামাজের কালে, গিয়াছিলাম গোয়াল ঘরে গাভি রইল হাওরেতে, বাছুর আমার বান্ধা নায় ॥ এশার নামাজ কালে, বিবি বলে চাউল ফুরাইছে ছেলেমেয়ের কান্দন শুনে কান্দে পাগল দুর্বিন শায় ॥
এক কঠিন বাস্তবতাকে দুর্বিন শাহ তার এই গানে ধারণ করেছেন। মুসলিম ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সাংসারিক বিবিধ ঝামেলা, অভাবের তাড়না এবং কাজের চাপ তাকে সময়মতো নামাজ পড়া হতে দূরে রাখছে। তার কাছে মনে হয়েছে, নামাজের চেয়ে কাজটাই অনেক বড়। কী কঠিন বস্তুবাদী উচ্চারণ! এ রকম বাস্তব কিন্তু কঠিন উচ্চারণ সবাই করতে পারে না। তিনি সেটা পেরেছিলেন। সে কারণেই বাউল ঘরনায় তিনি অনন্য। এ রকম অসংখ্য বস্তুবাদী চিন্তাসমৃদ্ধ কথামালা দুর্বিন শাহের গানের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে। বিখ্যাত এই বাউলসাধক ৫৭ বছর বয়সে ১৯৭৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ৩ ফাল্গুন) নিজ বাড়িতে মারা যান। প্রতিবছর বাঊল সাধক দুর্বিন শাহ ও সফাত আলী শাহ”র মাজার দুর্বিন টিলায় পবিত্র ওরস অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ খ্রীঃ দুর্বিন টিলায় বার্ষিক ওরস অনুষ্ঠিত হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ- মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান (ডালিম)
মোবাঃ- 01712-174796
অনলাইন সম্পাদক : জাকারিয়া হোসেন জোসেফ
মোবাঃ- 01711-145909
ইমেইলঃ-newssylbangla@gmail.com
রংমহল টাওয়ার ৪র্থ তলা বন্দর বাজার, সিলেট।
Design and developed by M-W-D