ভারতে নকল ও ভেজাল ওষুধে সয়লাব বাজার, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

প্রকাশিত: ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৯, ২০২৫

ভারতে নকল ও ভেজাল ওষুধে সয়লাব বাজার, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

ডেস্ক রিপোর্ট:

নকল ওষুধের ব্যবসা ভাবিয়ে তুলেছে মানুষকে। ওষুধের গুণগত মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। বাজার যখন নানা ধরনের নকল ওষুধে সয়লাব, আশঙ্কা দেখা দিয়েছে জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে।

বাজারে এখন ওষুধ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতার সামনে বেশি বিকল্প এসে উপস্থিত হয়েছে। ব্র্যান্ডেড ওষুধের পাশাপাশি এসেছে জেনেরিক মেডিসিন। কিন্তু প্রশ্ন উঠে গেছে ওষুধের গুণমান নিয়ে। একইসঙ্গে চিন্তা বাড়িয়েছে ভেজাল ওষুধ।

পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্ব ভারতের বাজার ছেয়ে গেছে ভুয়া ওষুধে। বিভিন্ন নামে ব্র্যান্ডের ওষুধ নকল করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বাজারে। দোকানে দোকানে সেই জাল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। অসাধু ডিস্ট্রিবিউটারদের হাত ধরে খুচরো বিক্রেতাদের কাছে এসে পৌঁছচ্ছে ভেজাল ওষুধ। সেই ওষুধ দোকান থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। তারা স্ট্রিপ দেখে বুঝতেও পারছেন না যে এটা ভেজাল ওষুধ।

খুব সাধারণ অথচ প্রতিদিনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ডায়াবেটিস, হাই ব্লাডপ্রেসার ইত্যাদি সমস্যার চেনা ব্র্যান্ড নামের ওষুধ দোকানে বিক্রি হচ্ছে। এই ব্র্যান্ড নামে চিকিৎসকরা বছরের পর বছর ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখছেন। ভেজাল ওষুধ খেয়ে শরীরের সমস্যা যাচ্ছে না। ফলে একেবারেই অন্ধকারে থাকছেন রোগীরা, চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও রোগ নির্ণয় করতে সমস্যা হচ্ছে।

সম্প্রতি বিহারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি নকল ওষুধের চক্র সামনে এসেছে। এরা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় জাল ওষুধ সরবরাহ করত। হাওড়া জেলার আমতা থেকে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ উদ্ধার করা হয়েছে।

২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ৩০০টি প্রয়োজনীয় ওষুধের গুণমান বজায় রাখতে সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোকে ওষুধের ওপর কিউআর কোড লাগানোর নির্দেশ দেয়। সেই অনুযায়ী ওষুধের স্ট্রিপ, সিরাপের বোতলে কিউআর কোড লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ওষুধের কিউআর কোড জাল হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা বিষয়টি জানায় রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলে।

ড্রাগ কন্ট্রোলের তদন্তে উঠে এসেছে, এই জাল ওষুধ বিহার থেকে আনা হয়েছে। আমতার একটি ওষুধ সরবরাহকারী সংস্থা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এই ওষুধ পৌঁছে দিয়েছে। ওই সংস্থার গুদামে হানা দিয়ে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ উদ্ধার করে ড্রাগ কন্ট্রোল। সংস্থার মালিককে আটক করা হয়। সূত্রের খবর, এই সংস্থা এক কোটি ৮৬ লাখ টাকার নকল ওষুধ বাজারে সরবরাহ করেছে।

সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (সিডিএসসিও)- এর সূত্র অনুযায়ী, গত তিন মাসে প্রায় ৩০০টি ওষুধ গুণমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এর মধ্যে এ রাজ্যের একাধিক প্রস্তুতকারকের তৈরি ওষুধও রয়েছে। গুণগত মানের জন্য পশ্চিমবঙ্গে বিক্রি হওয়া কয়েকটি ওষুধ ছাড়পত্র পায়নি। এর মধ্যে ডিসেম্বরে ১৭টি, জানুয়ারিতে ২৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৫টি ওষুধ রয়েছে।

এই ৬৬টি ওষুধের মধ্যে রয়েছে বহু আলোচিত ‘রিঙ্গার ল্যাকটেট’ স্যালাইন। গত মাসেই ‘পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যাল’-এর তৈরি এই স্যালাইন নিয়ে অভিযোগ ওঠে। পরীক্ষার পরে দেখা যায়, এই সংস্থার তৈরি দ্রব্যের ১৬টি নমুনাই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। কর্নাটকের বেলারি জেলা হাসপাতালে ওই সংস্থার স্যালাইন ব্যবহারে পাঁচ প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে একইভাবে প্রসূতি মৃত্যুতে আঙুল ওঠে এই স্যালাইনের দিকে।

এই পরিস্থিতি এড়াতে নিম্নমানের ওষুধ ব্যবহার রুখতে নির্দেশিকা জারি করেছে স্বাস্থ্য দপ্তর। স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের জারি করা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, পরীক্ষায় যে সব সংস্থার যে ব্যাচের ওষুধ বাতিল হয়েছে, তার তালিকা সব সরকারি হাসপাতাল, পাইকারি বিক্রেতা এবং ডিস্ট্রিবিউটরদের জানাতে হবে ড্রাগ কন্ট্রোলকে। কোথাও কোনোভাবে এই খারাপ মানের ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না।

শুধু নির্দেশ দিয়ে কাজ ফুরোচ্ছে না ড্রাগ কন্ট্রোলের। স্বাস্থ্যসচিবের নির্দেশিকা অনুসারে, এই ওষুধ কোথাও বিক্রি হচ্ছে কি না, সেদিকেও কড়া নজর রাখতে হবে তাদের। আচমকা পরিদর্শন চালাতে হবে। একইসঙ্গে খারাপ মানের ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে জনস্বাস্থ্য নিয়ে। কিন্তু কোন পথে তা নিশ্চিত করা যাবে, সেটা নিয়ে স্পষ্ট দিশানির্দেশ নেই রোগী ও তার পরিবারের কাছে। এমনকী ওষুধ ব্যবসায়ী ও ফার্মেসির খুচরো বিক্রেতারা ধাঁধার মধ্যে আছেন। এ কথা কবুল করেছে বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশন বিসিডিএ।

এই সংগঠনের দাবি, ৩৫ শতাংশ জাল ওষুধ তৈরি হয় এ দেশে। মিশর এবং চীনেও জাল ওষুধের বড়সড় কারবার আছে। ওষুধে ছাড় দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নকল ওষুধ বাজারে ছেয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করছে তারা। অনেক বড় ওষুধ বিক্রেতা সংস্থা ২০–২৫ শতাংশ হারে ওষুধ বিক্রি করছে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ছোট ব্যবসায়ীরা ভুঁইফোঁড় ডিস্ট্রিবিউটরের কাছ থেকে ওষুধ কিনছেন। এই সুযোগে ভেজাল ছড়াচ্ছে জাল ওষুধের কারবারিরা।

রোগী ও তার পরিবারকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, এ ছাড়া জাল ওষুধের হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই। এমনটাই নিদান দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, ‘সিডিএসসিও তাদের ওয়েবসাইটে অ্যালার্ট জারি করে। অর্থাৎ, প্রত্যেক মাসে কোন কোম্পানির ব্র্যান্ড নেমে কী ওষুধ নিম্নমানের বলে ধরা পড়েছে, সেটা প্রকাশ্যে আনে। একে নন স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি (এনএসকিউ) অ্যালার্ট বলা হয়। এগুলো এড়িয়ে ওষুধ কিনলে ভালো হয়। তার পরামর্শ, অনেক সময় ওষুধের দোকানে একই কম্পোজিশনের ওষুধ দিয়ে দেওয়া হয়। সেটা না নেওয়াই উচিত। চিকিৎসক যে নামের ওষুধটি লিখেছেন, সে নামের ওষুধ কেনারই চেষ্টা করবেন, তাহলে অনেকটা নিরাপদ থাকা যাবে।

পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ চিকিৎসক যে ধরনের ওষুধ লেখেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চমূল্যের। সেই ওষুধ যে দামে সাধারণ ক্রেতা কেনেন, তার থেকে অনেক কম দামে ড্রিস্ট্রিবিউটার বিক্রি করেন ওষুধ ব্যবসায়ীদের। অনেক সময়েই অভিযোগ ওঠে, কম দামের বিকল্প ওষুধ থাকা সত্ত্বেও সেগুলো অনেক চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে লেখেন না, যেহেতু তাদের সঙ্গে ওষুধ সংস্থার অসাধু সম্পর্ক আছে।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ অনেকটা অসহায়। কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে অনেক কম দামে জেনেরিক ওষুধ বিক্রির দোকান খুলেছে দেশ জুড়ে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। রোগীর মধ্যে জেনেরিক ওষুধ সম্পর্কে ধারণাও স্পষ্ট নেই।

বিসিডিএ সম্পাদক পৃথ্বী বসু ডিডাব্লিউকে বলেন, সাধারণ মানুষের উচিত পাড়ার পরিচিত দোকান থেকে ওষুধ কেনা, যেখান থেকে দীর্ঘদিন তারা ওষুধ কিনছেন। আমরাও ওষুধ বিক্রেতাদের বলছি, তারা যেন অপরিচিত হোলসেলারের কাছ থেকে ওষুধ না নেন। ছাড়ের প্রতিযোগিতায় সামিল হয়ে গেলে জাল ওষুধ ঢুকে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

জেনেরিক ওষুধ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, জন ঔষধির দোকানে যে ওষুধ দুই টাকায় বিক্রি হয়, তা আমাদের ২০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। দেশের সব দোকানে কেন দুই টাকায় বিক্রি করা যাবে না? ওষুধের ওপর যে জিএসটি নেওয়া হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে বিবেচনা করতে হবে।

ডা. গোস্বামী বলেন, একটা শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ নিয়ে জনগণের রাস্তায় নামা উচিত। নেতারা যখন ভোট চাইতে যাবেন, তখন তাদের কাছে প্রশ্ন করা উচিত, কেন তারা ওষুধের সঠিক গুণমান নিশ্চিত করতে পারছে না। এটা যতদিন না সাধারণ মানুষ করতে পারছে, তত দিন এই অসাধু ব্যবসা থাকবেই।

তথ্যসূত্র: ডয়েচে ভেলে

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Live TV