প্রস্তুত হচ্ছে ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ রূপকল্প

প্রকাশিত: ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০২৫

প্রস্তুত হচ্ছে ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ রূপকল্প

ডেস্ক রিপোর্ট:

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গঠিত বাংলাদেশকে ফার্স্ট রিপাবলিক উল্লেখ করে নতুন গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সেকেন্ড রিপাবলিকের (বাংলাদেশ ২.০) ওপর বহুদলীয় নতুন সংবিধান প্রতিষ্ঠা চায়। তাদের মতে, পুনর্গঠিত রাষ্ট্রই হবে সেকেন্ড রিপাবলিক, যার মধ্য দিয়ে শুরু হবে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য নতুন যাত্রা।

নতুন দলটি দেশের প্রথম সংবিধানকে (বাহাত্তরের) একদলীয় সংবিধান আখ্যায়িত করে বলছে, বাহাত্তরের সংবিধানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের চেতনা থাকলেও ৫৪ বছরে শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের কারণে কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। যার ফলে রাষ্ট্র বারবার স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে ভেঙেপড়া রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করতে চায় তারা।

সেকেন্ড রিপাবলিকের ব্যাখ্যায় যা বলছে এনসিপি

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী প্রথম রিপাবলিকে শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নহীন রাষ্ট্র গঠন ভিত্তি হলেও রাষ্ট্রব্যবস্থা বারবার সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। ১৯৭২ সালের একদলীয় সংবিধানে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা এবং ক্ষমতাকাঠামোয় সরকার ও প্রধানমন্ত্রী স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে।

পরবর্তী সময়ে সংবিধানের সংশোধনীগুলোতে ধাপে ধাপে স্বৈরতন্ত্র পোক্ত হয় এবং জনগণের ক্ষমতায়ন ও গণতন্ত্র উপেক্ষিত হয়। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি করলেও তিন জোটের রূপরেখার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার অধরা থেকে যায়। গণতন্ত্রের মোড়কে জনগণের স্বার্থবিরোধী স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেই ধারাবাহিকতায় বিগত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের হাতে নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় রূপ নেয়। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় স্বার্থে ব্যবহার, নির্বাচন কাঠামো ধ্বংস, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া, বিরোধীদল দমন, ভিন্নমতের মানুষকে গুম-খুন, ইচ্ছেমাফিক ক্রসফায়ার ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, লুটপাট করে অর্থনীতি ধ্বংসসহ দুর্নীতি-অনিয়ম মহামারির রূপ নেয়।

এর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা সংগঠিত হয়ে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে এক দফার গণঅভ্যুত্থান ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। নতুন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি নিয়ে অগ্রসর হয় ছাত্র-জনতা।

এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা চায় এনসিপি।

সেকেন্ড রিপাবলিকের রূপকল্প

এনসিপির লক্ষ্য প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জনগণের ভোটাধিকার অবাধ ও সুরক্ষিত করা, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে জবাবদিহিমূলক ও জনসেবামুখী করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা, অর্থনৈতিক সুবিচারের মাধ্যমে লুটপাট ও বৈষম্যের অবসান ঘটানো, সাধারণ মানুষের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা গঠন করা।

তাদের আরো লক্ষ্য সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের অবসানসহ প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার খর্বকরণ, পরিবারতন্ত্র বাদ দিয়ে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন, বিনা ভোট ও ভোট কারচুপির অবসান, অর্থ পাচার রোধসহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা।

এ ছাড়াও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রথা বাতিল, পুলিশকে জনগণের সেবক হিসেবে গড়ে তোলা, বিদেশি প্রভুদের খবরদারি বন্ধ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মামলা বাণিজ্যের অবসান, নাগরিকের ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ, মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কর্মসংস্থানের উদ্যোগ এবং ধর্মবর্ণগোত্র নির্বিশেষে জনগণের সমান অধিকার, সমমর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

এনসিপির নেতাদের বক্তব্য

এনসিপির নেতারা বলছেন, একাত্তর মেনেই তাদের দল সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের জনআকাঙ্ক্ষা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়েছে।

এছাড়া গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষাও বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো দেশে ‘হাইব্রিডি কালচারাল পলিটিকস’বিস্তার লাভ করে গণবিরোধী অবস্থার দিকে নিয়ে গেছে। ৭২-এর সংবিধান ফ্যাসিবাদকে ত্বরান্বিত করেছে। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং রাজনৈতিক নতুন বন্দোবস্ত এখন সময়ের দাবি, সিংহভাগ মানুষের চাওয়া।

তারা বলছেন, সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয়তাবাদের বিতর্ককে ছাপিয়ে দেশের সব জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর ধারণাকে সামনে নিয়ে আসা হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামবিদ্বেষ একধরনের বর্ণবাদে পরিণত করেছে পতিত আওয়ামী লীগ। সব ধর্মের, সব জনগোষ্ঠীর, সব নাগরিকের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে সেকেন্ড রিপাবলিকে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। নতুন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন, রাষ্ট্র ঠিক করতে সংস্কার প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও সব নাগরিকের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে সবার আগে প্রয়োজন একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান, যা গণপরিষদের মাধ্যমে হতে হবে। নতুন সংবিধানের অধীনে নির্বাচন হবে। অন্যথায় আগের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ফিরে আসবে। সেটি যাতে না হয়, সেজন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দবস্ত দরকার।

তারা বলছেন, সংস্কারের ক্ষেত্রে সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে করতে হবে, তাদেরকে সেই ম্যান্ডেট দেওয়া হয়েছে। এনসিপির নেতারা বলছেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে আসা রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্যদের প্রস্তাবগুলো মিনিমাম রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে গেলেই একটা নতুন সংবিধান হয়ে যাবে। সে কারণে বিদ্যমান সংবিধানের ঘষামাজা করা সংশোধনী নয়, বরং সংস্কার বা নতুন সংবিধান চাইছে এনসিপি।

এ বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার দৈনিক আমার দেশকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসহ বিদ্যমান সংবিধানের মূল ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন করা ছাড়া জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে করা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সংসদে গিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করা অসম্ভব। সেজন্যই গণপরিষদ নির্বাচন চায় এনসিপি। এ নির্বাচনও একধরনের জাতীয় নির্বাচন, এটি জাতীয় নির্বাচন পেছানোর কোনো পাঁয়তারা নয়।

তার মতে, এক্ষেত্রে গণপরিষদ ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গেও হতে পারে, আবার বিকল্পও রয়েছে। গণপরিষদের নির্বাচিতরা প্রথমে গণপরিষদ গঠন করতে পারে, তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি সংবিধান উপহার দেবে, সেটি জুলাই চার্টারের দলিলের ভিত্তিতে হতে পারে। নতুন প্রণীত সংবিধান গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদন নিয়ে নিতে হবে। এরপর ওই গণপরিষদই বাকি সময় সংসদ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার পরিচালনা করবে। আবার গণপরিষদ ও আইনসভা একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল থাক পারে, সেটি নিয়েও আলোচনা-আলোচনা হতে পারে।

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনকেন্দ্রিক সাংগঠনিক বা দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়ে গণরাজনীতি করতে চায় এনসিপি। এখানে কেবল ভোট দেওয়াই শেষ নয়, জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে বাস্তবায়ন করতে চায়। বিদ্যমান ব্যবস্থা অকার্যকর ও ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়ায় আমূল পরিবর্তন করতে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চায় নতুন দল।

এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) এসএম শাহরিয়ার বলেন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটাতে রাষ্ট্রের সংস্কার জরুরি। এজন্য নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান, জুলাই চার্টার ও জুলাই ঘোষণাপত্র হওয়া দরকার। আগামীর নতুন বাংলাদেশ ও জনআকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র গড়তে এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য এখন সময়ের দাবি।

এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক খান মুহাম্মদ মুরসালীন বলেন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনর্গঠনে নতুন সংবিধানের বিকল্প নেই। সেই অভিপ্রায় উঠে এসেছে সাম্প্রতিক জনমত জরিপেও। তার ভিত্তিতে সেকেন্ড রিপাবলিকের মাধ্যমে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবতান জরুরি।

দেশে দেশে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড রিপাবলিক

ইউরোপের দেশ স্পেনে ১৯৩১ সালে রাজতন্ত্রের সঙ্গে জনগণের অসন্তোষ ও তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর পরিবর্তনের সামাজিক দাবিতে প্রজাতন্ত্রী শক্তির বিজয় ঘটে। দেশটির রাজা দেশত্যাগ করে এবং দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণা হয়। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র অধিকার ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বেশ কিছু অগ্রগতি অর্জন করে।

পোল্যান্ডে নাৎসি জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং স্লোভাক প্রজাতন্ত্র আক্রমণ করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব হারিয়ে দেশটিতে আসে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র। ১৮৪৮ সালে ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের আহ্বান জানানো হয়। মানবাধিকার এবং সাংবিধানিক সরকারের ওপর প্রথম ফরাসি প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে, তারা প্রথম প্রজাতন্ত্রের নীতিবাক্য গ্রহণ করে।

দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি একটি একক মেয়াদে সীমাবদ্ধ ছিল। কোস্টারিকায় ১৯৪৮ সালে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে ৪৪ দিনের গৃহযুদ্ধে দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের সূচনা হয়। নতুন সংবিধানের অধীনে ১৯৫৩ সালের প্রথম নির্বাচনে জয়লাভ করেন অভ্যুত্থানকারীরা। এই জাতি শান্তিপূর্ণভাবে ১৬টি ধারাবাহিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করেছে, যার সর্বশেষটি ছিল ২০১৮ সালে।

সুত্র.আমার দেশ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Live TV