অসাধু কর্মকর্তা ওসি প্রদীপ, পুলিশ প্রশাসনের অর্জন কলঙ্কিত করেছে।

প্রকাশিত: ৯:৪৮ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৮, ২০২০

অসাধু কর্মকর্তা ওসি প্রদীপ, পুলিশ প্রশাসনের অর্জন কলঙ্কিত করেছে।

কল্পনাকে হার মানায় ওসি প্রদীপের বর্বরতা

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রাশেদ খানকে ক্রসফায়ারের নির্দেশদাতা টেকনাফ থানার বহুল বিতর্কিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীসহ ৯ জনকে আসামী করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া তাদেরকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে এখনো তারা দৃশ্যত বহাল তবিয়তেই আছেন। ওসি প্রদীপ চাকরির অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও কক্সবাজার জেলা পুলিশে। যেখানে গিয়েছেন সেখানেই অপরাধ সংশ্লিষ্টতার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। অপরাধমূলক নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কর্মস্থল থেকে হয়েছেন বরখাস্ত, প্রত্যাহার ও বদলী। তাই যে প্রশ্নটি বার বার উঠছে তা হচ্ছে, যার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠে এসেছে, যার বর্বরতা কল্পকাহিনীকে হার মানায়, যার বিরুদ্ধে কয়েকবার বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছিল, সেই প্রদীপ কুমার দাশ কোন ক্ষমতাবলে এতদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছিলেন!

মাদক বিরোধী অভিযানে ২০১৮ সালের মে মাস থেকে ওসি প্রদীপের নির্দেশে কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ১৬১ জন যার বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছে ‘ক্রসফায়ার জোন’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মেরিন ড্রাইভ এলাকায়। মাদক কারবারিদের নির্মূল করার ঘোষণা দিলেও পুলিশের ক্রসফায়ারে উল্লেখযোগ্য কেউ নিহত হয়নি। আত্মসমর্পণের নামে শীর্ষ কারবারিদের রেহাইয়ের সুযোগ দিয়ে এবং চুনোপুঁটি বা নিরীহদের দমন করে চলেছে ‘ক্রসফায়ার বাণিজ্য’। এছাড়া নিহতদের অনেকের সঙ্গে মাদক ব্যবসার নূন্যতম সম্পর্ক ছিল না। নিরীহদের ধরে নিয়ে নিজের টর্চার সেলে মাসের পর মাস আটকিয়ে সর্বস্ব লুটে হয় খুন,নয় অস্ত্র বা ইয়াবা দিয়ে চালান করা হয়েছে। আটককৃতদের স্ত্রী/কন্যারাও প্রদীপের ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ইয়াবা চোরাচালান যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলে আসছে।

ওসি প্রদীপের অপকর্মের ক্ষুদ্র পরিসংখ্যান:
টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমারের বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অনেকবার চাঁদাবাজি, স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণ, ইয়াবার নামে ব্যবসায়ীদের হয়রানি, মিথ্যা মাদক মামলায় ধনীদের ফাঁসিয়ে কোটি টাকা ঘুষ নেয়া সহ অগণিত অভিযোগ রয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত আলোচিত কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো:

১. কোতোয়ালীর এসআই থাকাকালে পাথরঘাটায় এক হিন্দু বিধবা মহিলার জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে। এমনকি তার বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ এলাকায় নিজের বোনের জমি দখলের অভিযোগও বাদ যায়নি। এ নিয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্ত করলেও অজ্ঞাত কারণে পার পেয়ে যান প্রদীপ কুমার দাশ।

২. ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা একটি বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা, বার্জ আটক এবং ১৮ দিন পর বার্জ মালিকসহ ১২ জনকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দিয়ে হয়রানি ও অনৈতিক সুবিধা নেয়ার ঘটনায় ফেঁসে যান তৎকালীন পতেঙ্গা থানার ওসি প্রদীপ। এ ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় হয়। বিষয়টি পুলিশ সদর দফতর ও তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা পৃথকভাবে তদন্ত করে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর ওসি প্রদীপকে পতেঙ্গা থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়।

৩. বরখাস্ত হওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় সুপার রিফাইনারির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ দশ জনের বিরুদ্ধে বায়েজিদ থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে প্রদীপ। এ ঘটনার পর পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে হয়রানির অভিযোগ করেন সুপার রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদ। অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আলমগীরকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বায়েজিদ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও দুই এসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দফতর।

৪. ওসি প্রদীপের একটি মামলায় রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করায় ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি এক আইনজীবীকে লালদীঘির পাড় থেকে ধরে নিয়ে থানায় আটকে রাতভর নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের শিকার ওই আইনজীবী সুস্থ হয়ে ২৯ জানুয়ারি আদালতে পাঁচলাইশ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, ওসি তদন্ত আজিজ আহমেদ, এসআই মাসুদ পারভেজসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ওসি প্রদীপের পক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবে না।

৫. ২০১৩ সালের ২৪ মে পাঁচলাইশ থানার পাশের একটি কমিউনিটি সেন্টার থেকে শিবির আখ্যা দিয়ে ৪০ শিক্ষার্থীকে আটকের ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের তোপের মুখে পড়েন ওসি প্রদীপ। সে সময় ওসি প্রদীপের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের ব্যাপক বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে তারা ওসিকে লাঞ্ছিত করে।

৬. পাঁচলাইশে ওসি থাকাকালীন বাদুরতলা এলাকায় এক বয়োবৃদ্ধাকে রাজপথে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ব্যাপক সমালোচিত হন ওসি প্রদীপ। এ ঘটনার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে টনক নড়ে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে ৫৪ ধারা, সিএমপি অ্যাক্ট-৮৮ ধারাসহ বিভিন্ন পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বহু অভিযোগ ওঠে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে বিভাগীয় তদন্ত করে ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট তাকে পাঁচলাইশ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়।

টেকনাফের ত্রাস প্রদীপ
১. ওসি প্রদীপ হোয়াইক্যং এর আনোয়ার নামের এক ব্যক্তিকে তিন দিন ধরে টর্চার সেলে নির্যাতন করে হত্যা করেন। প্রতিকার পেতে তার সুন্দরী স্ত্রী এবং বোন কক্সবাজার আদালতে আসলে খবর পেয়ে তিনি দুই নারীকে তুলে নিয়ে টানা ৫ দিন গণধর্ষণ করে প্রত্যেককে ইয়াবা দিয়ে চালান দেন।
২. দুবাই ফেরত এক যুবককে ধরে সকালে এক পা ও এক হাতে গুলি করে বাড়িতে ফোন করিয়ে নগদ ২২ লাখ টাকা নিয়ে সন্ধ্যায় ক্ষতস্থানে ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
৩. বৃক্ষ প্রেমিক হিসেবে পুরস্কার প্রাপ্ত হাবিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডে প্রদীপের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। প্রদীপ তাকে হাবিবের প্রতিপক্ষ শহীদের হাতে তুলে দিলে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলায় যাকে আসামী করা হয়েছে সেই সৈয়দ হোসেন হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস আগে থেকে মিথ্যা মামলায় জেলে ছিলেন বলে জানা যায়।
৪. ঝিমংখালীর একজন ৭০ বছরের অবসর প্রাপ্ত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে মাদক মামলা দেন প্রদীপ, অথচ তখন তিনি হজ্ব পালনরত ছিলেন। অতঃপর ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ৩ লাখ টাকা আদায় করা হয়। আদালত তাঁর পাসপোর্ট ও ভিসা রেখে জামিনে মুক্তি দিলেও আবার গ্রেফতার করা হয়।

৫. এই পর্যন্ত যতগুলো ক্রসফায়ার হয়েছে তার সবকটিতেই মাদক, অস্ত্র ও হত্যা তিনটি মামলা রুজু করে মৃত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজন ও সংশ্লিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আসামী করা হয়েছে। এরপর শুরু হয় গ্রেফতার বাণিজ্য। তারপর মামলার চার্জশীট থেকে আসামী বাদ দেওয়া ঢুকিয়ে দেওয়ার অজুহাতে আদায় করেন কোটি কোটি টাকা।
৬. হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহেশখালীর চিহ্নিত সন্ত্রাসী ফেরদৌস বাহিনীকে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছিল ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। সে সময় তার প্রত্যাহারের দাবিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবরে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছিল। সন্ত্রাসী বাহিনী থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে মহেশখালীর হেতালিয়া প্রজেক্টের লবণচাষি মো. আব্দুস সাত্তারকে ধরে পাহাড়ে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে এ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

আসামী ধরা ছাড়াও ওসি প্রদীপ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসে শতকোটি টাকা উপার্জন করেছেন বলে জানা যায়। নাজিরপাড়ার গরু ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বা সাবরাংয়ের সিকদারপাড়ার সুলতান আহমেদের ছেলে মাছ ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেনের মত অনেক দিনমজুরকে প্রাণ দিতে হয়েছে প্রদীপের দাবি করা টাকা পরিশোধ করতে না পারায়। ইয়াবা নির্মূলের জন্য বিশেষ অভিযান চালানোর সুযোগ নিয়ে গত দেড় বছরে টেকনাফে ১৫০টি বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিলিং জোন বানিয়ে শীর্ষ কারবারিদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। এভাবে সমঝোতায় আত্মসমর্পণ করে পার পেয়ে গেছে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা।

ওসি প্রদীপের নামের বেনামে শতকোটি টাকার অর্থ সম্পদ রয়েছে। কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় স্ত্রীর নামে লক্ষ্মী ম্যানশন নামে অভিজাত বহুতল ভবন, মুরাদপুর মোড়ে মহাসড়ক সংলগ্ন অভিজাত এলাকায় ৬ কাঠা জমি এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের আসামের রাজধানী গৌহাটি শহরের পল্টন স্টেশনের পাশে অভিজাত দুটি বাড়ীসহ বেনামে তার প্রচুর ভিত্ত-বৈভব রয়েছে যা দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। প্রদীপের ভাই সদীপ কুমার দাশও একটি থানার ওসি এবং তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ অগণিত; তিনিও কয়েকবার বরখাস্ত হয়েছেন। কিন্তু কারা তাকে রক্ষা করেছে, তাদের উদ্দেশ্য কি এবং তার রক্ষকরা সরকারের কতটা শুভাকাঙ্খী – এমন অনেক প্রশ্ন উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে!

সম্প্রতি সকল মহলে আলোচিত হচ্ছে যে, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা সিনহা রাশেদ খানের পেশাগত পরিচয় না থাকলে, সেও হয়তো পরিচিতি পেত মাদক ব্যবসায়ী বা সন্ত্রাসী হিসেবে। করোনা মহামারীতে পুলিশ প্রশাসন যে সুনাম অর্জন করেছে এবং জনমনে আস্থা সৃষ্টি করতে যে সক্ষমতা প্রদর্শন করছিলো, তাকে কলঙ্কিত করছে প্রদীপের মত হাতেগোনা কিছু অসাধু কর্মকর্তা। তাই এক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থার সংকটের পাশাপাশি অসন্তোষ সৃষ্টি হবে যা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য শুভ হবে না।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ