দৈনিক দিনরাত সংবাদ : ঠিক তিন বছর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনী দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার অজুহাতে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন চালানো হয় অসহায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়, সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু নিরাপত্তার জন্য প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
সহিংসতার পর অগণিত গবেষক, এনজিও, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি আচরণের জন্য মিয়ানমারের নিন্দা করেছে। অনেকে এই ঘটনাকে মুসলিম সংখ্যালঘু গ্রুপটির প্রতি জাতিগত নির্মূলের বাস্তব উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এক বছর পর ২০১৮ সালের আগস্টে ওই ঘটনার শিকার, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, স্যাটেলাইট চিত্র, বস্তুনিষ্ঠ নথিপত্রের আলোকে জাতিসঙ্ঘ অনুসন্ধানকারীরা ওই সহিংসতার একতরফা ও পরিকল্পিত প্রকৃতি প্রকাশ করেন। সবাই দেখতে পায় যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে, তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, যুদ্ধাপরাধ করেছে।
তার পরও রোহিঙ্গা গণহত্যার তৃতীয় বর্ষপুর্তিতেও মিয়ানমারের জাতিগত নির্মূল অভিযানে বেঁচে থাকা লোকজন এখনো ন্যায়বিচার পায়নি। কেবল যে মিয়ানমারের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদেরই বিচার থেকে রেহাই দেয়া হচ্ছে, তা নয়। বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে বসবাসকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গার দুর্দশা লাঘবের জন্যও বলতে গেলে কিছুই করা হয়নি।
বর্তমানে রোহিঙ্গাদের ভাগ্য নিয়ে আলোচনা মিয়ানমারে নয়, বাংলাদেশে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্ভবত বুঝতে পেরেছে যে তারা মিয়ানমারকে এসব রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে বাধ্য করতে পারবে না। আর তাই তারা উদ্বাস্তুদের জীবনমান উন্নত করার জন্য বাংলাদেশের ওপরই চাপ প্রয়োগ করছে।
অস্বীকার করা যায় না যে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মধ্যকার সম্পর্ক দ্রুত অবনতি হচ্ছে। তা সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশকে তাদের আশ্রয়ে থাকা লাখ লাখ লোকের জীবনমান উন্নত করতে বলাটা ভণ্ডামির পর্যায়েই পড়ে, বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে সামান্যই।
বাংলাদেশে প্রথম গ্রুপ রোহিঙ্গার আগমন ঘটে ১৯৭৮ সালে। ওই সময় মিয়ানমার সরকার তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে অভিহিত করেছিল। তাদেরকে বিতাড়নের জন্য অপারেশন ড্রাগন কিং নামের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। ওই সময় পরার কাপড়া ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসতে পারেনি দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
তারপর ১৯৯১-৯২ সময়কালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী অপারেশন ক্লিন অ্যান্ড বিউটিফুল ন্যাশন পরিচালনা করে। এটা তারা করে বিদেশী তাড়াতে। এ সময়ও আরো দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
আর ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসে আরো সাড়ে সাত লাখ। তাদের জন্য ৩৪টি অস্থায়ী ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় লোকজন তাদেরকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানায়। তবে তাদের আগমনে শ্রম অনিশ্চয়তা, খাদ্য মূল্য বৃদ্ধি, পানির স্বল্পতা, পরিবেশগত ক্ষতি ও অপরাধ বাড়ায় স্থানীয়রা তাদের দ্রুত ফেরত যাওয়ার দাবি জানাতে থাকে।
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনের জন্য বেশ কয়েকটি চেষ্টা হয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একটি সমঝোতায় উপনীত হয়। কিন্তু নিরাপত্তার কথা বলে রোহিঙ্গারা যেতে না চাওয়ায় উদ্যোগটি ভণ্ডুল হয়ে যায়।
বস্তুত, ২০১৭ সালের সহিংসতার পর থেকে উদ্বাস্তুদের নিরাপদে ফেরত নিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কিছুই করেনি। নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া প্রত্যাবর্তনকারী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। তাছাড়া যে কারণে রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে, তারও কোনো উন্নতি হয়নি।
এখনো রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার কেবল নৃশংসতা অব্যাহতই রাখেনি, সেইসাথে নতুন নতুন অভিযানও চালাচ্ছে। মিয়ানমারের বৌদ্ধরা বারবার বলে আসছে, তারা রোহিঙ্গাদের চায় না।
বাংলাদেশ পড়ে গেছে কঠিন অবস্থায়। তারা না পারছে তাদের ফেরত পাঠাতে, না পারছে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে।
গত তিন বছরে অল্প কয়েকটি দেশ মাত্র রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা করেছে। তবে গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে বিষয়টি উত্থাপন করে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকীকরণে সহায়তা করেছে। যদিও এতে বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই।
এখন রোহিঙ্গা গণহত্যার তৃতীয় বার্ষিকী পালনের সময় রোহিঙ্গাদের কিছু সহায়তা দিয়েই ক্ষান্ত হলে চলবে না। এটা তাদের দেশে ফেরত যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করবে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রয়োজন নিরাপদে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা। তা করতে ব্যর্থ হলে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার অবসান ঘটবে না।