শ্রীমঙ্গলে সরকারী কলেজের ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার,হত্যা না আত্নহত্যা

প্রকাশিত: ৭:০০ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২০

শ্রীমঙ্গলে  সরকারী কলেজের ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার,হত্যা না আত্নহত্যা

দৈনিক দিনরাত:

সাক্ষর দেব ছেলেটি:মৃত্যুর আগে মোবাইল ফোনে দুই তরুণীর সাথে কথা বলেন।

গত রোববার (৩০ আগস্ট) ভোরে শ্রীমঙ্গল চা বাগানের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় কলেজ ছাত্র সাক্ষর দেব (১৭) এর মরদেহ। মরদেহের পাশ থেকে কিছু ঘুমের ওষুধ এবং বিষাক্ত কীটনাশক এ্যালমুনিয়াম ফসফেট ট্যাবলেটও উদ্ধার করা হয়। তার মৃত্যু হত্যা না আত্মহত্যা তা তদন্ত করে দেখছে পুলিশ।

তদন্তসংশ্লিস্ট সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুর আগে মোবাইল ফোনে সিলেট ও শ্রীমঙ্গলের দুই তরুণীর সাথে কথা বলেন সাক্ষর। তাদের একজনের সাথে মোবাইলে ম্যাসেজ বিনিময়ও হয় তার। এ্যালমুনিয়াম ফসফেট খেলে কি হয় ম্যাসেজে এক তরুণীর কাছে এমনটিও জানতে চান সাক্ষর।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সরকারী কলেজের কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাক্ষর দেব গত শনিবার বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিখোঁজ হন। সারারাত তার সন্ধানে উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি করার পরও তার সন্ধান পাওয়া যায় নি৷ পরদিন রবিবার ভোরে শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালীঘাট ইউনিয়নের লাখাইছড়া চা বাগানের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় সাক্ষরের মরদেহ৷

মরদেহের পাশে পাওয়া যায় কিছু ঘুমের ওষুধ ও এ্যালুমিনিয়াম ফসফেট ট্যাবলেট৷ সাক্ষরের মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকেই পুলিশ, সিআইডি ও পিবিআই যৌথ তদন্তে নামে৷ মরদেহ উদ্ধারের পরদিন সোমবার (৩১ আগস্ট) সাক্ষরের বাবা কল্যান দেব বাদী হয়ে শ্রীমঙ্গল থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে একটি হত্যা মামলাও দায়ের করেন৷

মামলার এজাহারে কল্যান দেব অভিযোগ করেন, গত শনিবার (২৯ আগস্ট) বিকেল ৪ টার দিকে সাক্ষরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একটি কল আসে। এরপর মোটর বাইক নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়েন সাক্ষর। ঘন্টা দু’য়েকের মধ্যে ফিরে না আসলে সাক্ষরের মা সাক্ষরের বাবা কল্যান দেবকে বিষয়টি জানান। এর পর তার ফোনে কল করলে ওপর প্রান্ত থেকে সাক্ষর ফোন রিসিভ করেনি। এক পর্যায়ে খোঁজাখোঁজি করে না পেয়ে ওই রাতেই শ্রীমঙ্গল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন বাবা।
বিজ্ঞাপন

কল্যান দেব এজাহারে আরও উল্লেখ করেন, ঐ রাতে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে একজন অজ্ঞাতনামা নারী ফোন করেন তবে তিনি নিজের ব্যস্ততার কারনে ঐ নারীর সাথে কথা বলতে পারেননি। পরদিন সকালে পুলিশ মারফত জানতে পারেন তার ছেলের লাশ উপজেলার লাখাই চা বাগানের সেকশনের ভেতরের রাস্তায় শোয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। লাশের পাশে সাক্ষরের ব্যবহৃত মোটর বাইকটি ও আশেপাশে বিভিন্ন ওষুধের স্ট্রিপ ছড়ানো ছিলো। থানা পুলিশ ও সিআইডি সুরতহাল ও ঘটনার আলামত সংগ্রহ করে।

বাদীর ধারণা ঐদিন বিকেল ৫:৪০ মিনিট থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে অজ্ঞাতনামা কেউ সাক্ষরকে ওষুধের মিশ্রণ বা অন্যকোন উপায়ে হত্যা করে উক্ত স্থানে ফেলে রাখে।

মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকেই পুলিশ সিআইডি ও পিবিআই মিলে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে। পুলিশসহ সব তদন্তকারী সংস্থাই হত্যা এবং আত্নহত্যা দুটো মোটিভকে সামনে রেখেই তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘটনার দিন নিহত সাক্ষর দুপুরে তার ব্যাক্তিগত মটরবাইকে করে বাসা থেকে বেরিয়ে প্রথমে ইছবপুরের একটি দোকান থেকে ঠান্ডা পানীয় ক্রয় করে শ্রীমঙ্গল শহরের দিকে রওয়ানা দেন। সেখানে মাস্টারপাড়া নামক স্থানে কিছুক্ষন থেমে আবার রওয়ানা দেন ভানুগাছ সড়কের দিকে৷

বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে তিনি কালীঘাট সড়কের জোড়পুল তার মটরবাইকে করে পার হন৷ পুরো যাত্রায় তার সাথে তার মটরবাইকে আর কোন আরোহী ছিলেন না৷

এদিকে সাক্ষরের মৃত্যুর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলতে থাকেন- সাক্ষরের সাথে আরো তিনটি মটরবাইক সেদিন বাগানে ঢুকেছিলো এবং সাক্ষর ছাড়া বাকি মোটরবাইকগুলো বাগান থেকে বেরিয়ে আসে। তবে সিলেটটুডের অনুসন্ধানে দেখা গেছে ঘটনার দিন সাক্ষরের সাথে বা সাক্ষর যাওয়ার পরে এরকম কোন ধরনের মোটরবাইক ওই সড়ক দিয়ে তার সাথে বা পেছনে যায় নি৷

সাক্ষর যে রাস্তা ধরে কালীঘাট বাগানে গিয়েছিলেন সেই যাত্রাপথের একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করে কথিত তিনটি মটরবাইকের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি৷

সাক্ষরের দাদু কৃপেশ দেব এই প্রতিবেদক কে জানিয়েছেন, ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকে সাক্ষর কোন একটা বিষয় নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিলো৷

কৃপেশ দেব বলেন, ঘটনার দিন দুপুরে সাক্ষর তাড়াহুড়া করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়৷ পরে সাক্ষরের মা তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেন৷ প্রথমবার কল রিসিভ করার পর অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয় “এখানে সাক্ষর টাক্ষর কেউ নেই”। এরপর আবার কল দিলে একই কথা বলা হয়। তখনই আমরা বুঝতে পারি তাকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে এবং তার মোবাইলটি অপহরনকারীদের হাতে রয়েছে৷

তবে এই মামলার একাধিক তদন্তকারী কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদমাধ্যম কে বলেন, সাক্ষরের পরিবার থেকে যে মোবাইল কলের কথা বলা হচ্ছে সেটি সঠিক নয়৷ সাক্ষরের কল লিস্ট থেকে আমরা এরকম কোন কলের হদিস পাই নি৷

এদিকে সাক্ষরের কল লিস্টের তথ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে এসেছে। সেই কল লিস্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তার মৃত্যুর দিন দুটি নাম্বারে সাক্ষরের সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ হয়েছে। যার একটি নাম্বার শ্রীমঙ্গলের এক তরুণীর আরেকটি সিলেটের একজন তরুণীর৷

কল লিস্ট থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন সকালে সাক্ষর শ্রীমঙ্গলের তরুণীটিকে একাধিকবার কল করেছিলেন পাশাপাশি সিলেটের তরুণীরর সাথেও ম্যাসেজি বিনিময় করেন৷ শ্রীমঙ্গলের তরুণীর সাথে বিকাল পাঁচটার দিকে ৫ মিনিট ৫২ সেকেন্ড কথা হয় তারপর সিলেটের কিশোরীর সাথে ৫টা ২৪ মিনিটে দুইবার ম্যাসেজ বিনিময় হয়। ম্যাসেজে সাক্ষর জানতে চান- ‌’এ্যালুমিনিয়াম ফসফেট খেলে কি হয়?’। জবাবে ওই তরুণী জানান- ‘এটি খাওয়া ত দূরের কথা এটির বাতাসও বিষাক্ত’। তারপর সেই তরুণীর সাথে পাঁচটা ৫৫ মিনিটে যথাক্রমে ১৮ এবং ৫৮ সেকেন্ডের কথোপকথন হয়৷

সেই কথোপকথনটি সম্পর্কে সিলেটের সেই তরুণী বলেন, সাক্ষর যখন আমাকে ম্যাসেজ করে তখন আমি কোচিংয়ে ছিলাম। পরে আমি ম্যাসেজের রিপ্লাই দেই তারপর কোচিং থেকে বের হয়ে তাকে আমি কল করি কিন্তু দুবারই তার কোন কথা আমি বুঝতে পারি নি৷

তিনি বলেন, পরে আমি রাতে সাক্ষরকে পাওয়া যাচ্ছে না এরকম পোস্ট দেখি ফেসবুকে। সেই পোস্টের নিচে একটা নাম্বার ছিলো সম্ভবত নাম্বারটি তার বাবার৷ আমি সেদিন রাতেই কল করে সাক্ষরের আমাকে দেওয়া মেসেজটি সম্পর্কে উনাকে জানাই৷

সাক্ষরের সাথে কথার ব্যাপারে শ্রীমঙ্গলের তরুণীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনার দিন সকালে সে আমাকে কল করে তখন আমি স্টুডেন্ট পড়াচ্ছিলাম৷ সাক্ষর আমাকে জিজ্ঞেস করে এ্যালুমিনিয়াম ফসফেট খেলে কি হয়, তখন আমি বলি- আমি তো পড়াচ্ছি এটা বই দেখে বলতে হবে। তখন সে আমাকে গুগলে চেক করে দেখতে বলে। আমি তাকে তার মোবাইলে বিষযটি চেক করতে বলি৷ বিকেলে সে আমাকে ফোন করে আমার সাথে দেখা করতে চায়, আমি তাকে মানা করে দেই৷

এদিকে ঘটনার দিন সাক্ষরের নিজের ফেইসবুক আইডিতে ডেড লিখে বায়ো তে দেওয়া হয়৷

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সাক্ষরের সাথে যে মোবাইলটি ছিলো সেটিতে তার ফেসবুক আইডি লগইন করা হয়নি কখনোই৷ তার আইডি লগইন করা মোবাইলটি ছিলো তার বাবার কাছে। আমরা ধারনা করছি সে নিজেই তার ফেসবুকে এটা আপলোড করেছিলো৷

পলিশের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, সাক্ষরের লাশ যেখানে পাওয়া গিয়েছিলো সেখানে অন্যকোন সাইকেলের চাকার দাগ বা ফুটপ্রিন্টস পাওয়া যায় নি এবং সাক্ষরের মৃতদেহে কোন ধরনের আঘাত বা ধস্তাধস্তিরও আলামত পাওয়া যায় নি৷

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। শীগগীরই আপনাদেরকে পুরো বিষয়টি জানাবো৷
(সংগ্রহীত)

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ