এ সময়ে তো যাওয়ার কথা ছিলনা… আল আজাদ

প্রকাশিত: ২:২৫ অপরাহ্ণ, জুন ১৫, ২০২০

একদিন সবাই চলে যায়-যেতে হয়। তাকেও চলে যেতে হতো; কিন্তু এভাবে-এসময়ে তো যাওয়ার কথা ছিলনা। অনেক কাজ তার অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। তবু তিনি চলে গেলেন।
প্রতিদিনের মতো মেহেদী কাবুলের নিকট থেকে ফোনে খবর নিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি সম্পন্ন করলাম। আগের মতোই আছেন, খেয়েছেন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন-এসব স্বস্তিকর খবরে বিরামহীন মানসিক অশান্তির মধ্যেও কিছুটা শান্তি নিয়ে ঘুমোতে গেলাম মধ্যরাতে। অন্যান্য রাতের মতোই ঘুম ভাঙলো শেষরাতে-যখন ঠিক ৪টা বাজে। নতুন অভ্যাস ‘হাতধোয়া’ পর্ব শেষ করে যেই বিছানায় যাবো অমনি ফোনটা বেজে উঠলো। ইদানিং রাত ১টার দিকে ফোন বন্ধ করে দেই। আজ ভুলে বন্ধ করিনি। অবশ্য অন্যটা খোলা থাকে, যে নম্বরটি সিলটিভি পরিবারের সদস্য ছাড়া আর খুব বেশি জনের জানা নেই। ফোন হাতে নিতেই দেখি বাদশা গাজীর নাম। আৎকে উঠলাম। আঁচ করলাম, দুঃসংবাদ। নাহলে এতো রাতে ঘুম ভাঙাতো না।
বাদশার প্রশ্ন, মেয়র সাহেবের (অভ্যাসটা পাল্টাতে পারিনি বলেই আমি তাকে মেয়র সাহেব বলেই বরাবর সম্বোধন করি। আমার বড় নানা ছিলেন জগদল ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান। পরে এ পদে না থাকলেও সারাজীবন সাধারণ মানুষ এমনকি তার পরবর্তী সময়ে যারা এ পদে আসীন হয়েছেন তারাও তাকে চেয়ারম্যান সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। আসলে সম্মানজনক কোন পদে কেউ প্রথম আসীন হলে এমনি হয়ে থাকে)। কোন খবর জানি কি না।
বললাম, না।
বললো, মুশফিক (মুশফিক জায়গীরদার) নাকি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে, কামরান সাহেব নেই।
বললাম, দেখছি।
ফেসবুক খুলেই দেখি, শোকসংবাদ আর শোক প্রকাশে ভরে আছে। একসময় হাত থেমে গেলো। আর কি হবে দেখে, যে সর্বনাশ হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। তবু কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে দু’লাইনের একটি পোস্ট দিলাম। খবর দিলাম সিলটিভি ও খবরসবরে। কারণ দর্শক-পাঠকদের এই দুঃসংবাদটি জানানো জরুরি হয়ে উঠেছে।
ফাইজা রাফা ফোন করলো। প্রতিবেদন তৈরি করে ফেলেছে। টুকটাক এদিক ওদিক করে দিয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিতে। এন্ড্রু আশীষ আপলোড করে দেবে।
আর ঘুম এলোনা। চোখের সামনে কেবল ভেসে বেড়াতে থাকলো ফেলে আসা দিনগুলো। স্মৃতিরপাতা এক এক করে উল্টে যেতে থাকলো। প্রায় তিনযুগের ঘনিষ্ঠতা। কত কাজ। সুখ-দুঃখে সময় পার। প্রতিদিন মধ্যরাতে ফোনে কথাবলা। নানা বিষয়ে জানতে চাওয়া। এটা করলে কি হবে-ওটা করলে কি হবে। কখনো কখনো, দায়িত্ব দিয়ে বলতেন, পরিকল্পনা তৈরি করুন। বিশেষ করে সাহিত্য-সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিষয়ে। অতঃপর এনিয়ে একান্তে আলোচনা। বাস্তবায়ন। অনুষ্ঠান। এত এত কর্মকাণ্ড যে, হুট করে লেখা যাবে না। তবে চেষ্টা করবো লিখতে।
কিছু কিছু বিষয় ছিল, যা নিয়ে সবার আগে কথা বলতেন আমার সঙ্গে। জানিনা কেন। হয়তো ভরসা করতেন-বিশ্বাস রাখতেন। আমিও চেষ্টা করেছি তাকে সহযোগিতা করতে, তার ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাতে, তিনি যে স্বপ্ন বুনতেন তা যথাযথ বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে।
সিলেটে অমর একুশে উপলক্ষে প্রভাতফেরি পুনরায় চালু, মহান স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাসে বর্ণাঢ্য আয়োজন, জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের মৃত্যুবার্ষিকী পালন, সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বীর মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা, পবিত্র ঈদুল ফিতরে শুভেচ্ছা বিনিময়, বৈশাখী মেলা, গণমানুষের কবি দিলওয়ার ও বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের সংবর্ধনা, বাজেট উপস্থাপনকালে সাংবাদিকদের জন্যে উপহার সামগ্রীর ব্যবস্থা-এরকম আয়োজনগুলোর কোন কোনটি ছিল শুধুমাত্র আমরা দু’জনের যৌথ চিন্তাভাবনার প্রতিফলন।
তথাকথিত এক-এগারোর সরকারের আমলে প্রথম গ্রেফতার হলেন বাসা থেকে। আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা সে রাত ছড়ারপারে বাসায়ই কাটালাম। ভোরে কোতয়ালি থানার ওসি আব্দুন নূর এসে যথাযথ মর্যাদায় তাকে নিয়ে গেলেন। পিছু নিলাম সবাই। গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে এমন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
গ্রেফতার হলেন আবারো। আমি সেদিন ঢাকায় ছিলাম। মুক্ত হয়ে ফিরে এলেন। দেখা হওয়া মাত্রই জিজ্ঞেস করলেন, আগে বলুন, ভাবী কেমন আছেন। জানতেন, আমার সহধর্মিণী (দীপা নাহার মুর্শেদা) অনেক বছর যাবৎ অসুস্থ। এ অবস্থায়ও যখনই দু’জনের দেখা হতো, তখনই নাগরিক সুখ-সুবিধা নিয়ে নানান দাবি জানাতেন। মেয়র তার সেই অতুলনীয় হাসি উপহার দিয়ে আশ্বাস দিতেন, দাবি পূরণের। কিছু কিছু দাবি পূরণও করেছিলেন।
তার জিজ্ঞাসার উত্তরে জানালাম, তিনি মারা গেছেন। হাসিমাখা মুখটি বেদনায় নীল হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শাস্তনা দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
একদিন তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটির খবর। জানিয়েছিলাম, তিনি আর নেই। আর আজ দেশ-বিদেশ থেকে ফেসবুকে কিংবা ফোনে যখন বিভিন্নজন জানতে চাইছেন কামরান সাহেবের খবর-তখনও বলছি, তিনি নেই-চলে গেছেন সেই আজানায় যেখান থেকে ফিরে আসা যায়না।
আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি। পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। গণমাধ্যমের ভাললাগা মানুষ। এতগুলো গুণ নিয়ে খুব কম মানুষই জন্মায়। সুরমাপারে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান জন্মেছিলেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ