বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: দন্ত-নখর সব হারিয়েছে নেকড়ে

প্রকাশিত: ২:৩১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: দন্ত-নখর সব হারিয়েছে নেকড়ে

দৈনিক সিলেটের দিনরাত:
~

দক্ষিণ এশিয়ার দৃশ্যপটে একসময় যে বড় ভাই আধিপত্য করেছে, সেই ভারত এখন ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। স্বঘোষিত পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের দাম্ভিক আত্মবিশ্বাস দ্রুত মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। তাদের প্রতিবেশী দেশগুলো একের পর এক তাদের দীর্ঘদিনের আধিপত্যকে রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ভারত এখন বুঝতে পারছে যে, আগের বল প্রয়োগের কৌশল দিয়ে এখন আর কোন কাজ হবে না।

প্রশ্নটা হলো কেন? কিসে এ অঞ্চলের সমীকরণ বদলে গেছে? এটা কি শুধুই চীনের অতিরিক্ত উপস্থিতি, যেটা অর্থনৈতিক বিনিময় থেকে বেড়ে ভূরাজনৈতিক বলয়ে প্রবেশ করেছে এবং ভারতকে তাদের আঞ্চলিক শক্তির জায়গা থেকে সেটা আস্তে আস্তে সরিয়ে দিচ্ছে?

আঞ্চলিক ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা স্বীকার করেন যে, চীন তার খোলস থেকে বেরিয়ে এসে আরও দৃশ্যমান হয়েছে এবং তার শক্তিশালী উপস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভারতের অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে। তবে একই সাথে তারা এখানে আরও বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছেন।

“দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশী একাডেমিক আকরাম হোসেন বলেন, “ভারত তার নিজের বোকামির জন্য মূল্য দিচ্ছে। নিজেদের ঔদ্ধত্যকে তারা অনেক দূর নিয়ে গিয়েছিল এবং সওয়ারির পিঠে অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়েছিল। প্রতিবেশী যত দুর্বলই হোক না কেন, কি পরিমাণ চাপ তারা নিতে পারবে, তার একটা সীমা আছে। আর দৃশ্যপটে ‘নতুন বালক’ চীনের প্রবেশের পর ছোট দেশগুলো বুঝতে পেরেছে যে, বিরাট নেকড়ের মোকাবেলায় তারা আর একা নয়। আর সেজন্যেই জলহস্তি তার শক্তি হারাচ্ছে”।

ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশ সম্ভবত ভারতের ‘শ্রেষ্ঠত্বের’ ধারণার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। পাকিস্তানের সাথে ভারতের শত্রুতার বিষয়টি গোপন কোন বিষয় নয় এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কে ভালোবাসা-ঘৃণা মিলে মিশে আছে। কখন ভালোবাসা এগিয়ে থাকে সেখানে, কখনও ঘৃণা। কিন্তু ঐতিহাসিক কারণেই হোক, বা ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং অন্যান্য কারণেই হোক, বাংলাদেশ সবসময় ভারতের পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে ছিল। হ্যাঁ, সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের জনগণকে ভারত-বিরোধী মনে করা হয়, কিন্তু অতিমাত্রায় বন্ধুত্ব আর আন্তরিকতা দিয়ে, এবং মাঝে মাঝে অতিরিক্ত অবনত আচরণ দিয়ে বাংলাদেশের সরকারগুলো সেই ঘাটতি পূরণ করে দিয়েছে।

এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে ভারত-বিরোধী সরকারও প্রতিবেশী দেশের সাথে কঠিন দর কষাকষিতে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তো ভারতের আনন্দের কোন সীমায় থাকে না। এই সরকার ভারতকে প্রায় নিঃশর্তভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে, এমনকি নিজের জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েও তারা সেটা করছে। কিন্তু সেই স্রোতটা এখন স্পষ্টতই পাল্টে যাচ্ছে। এবং ভারত এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই হোক, চীনের পরোক্ষ প্রভাব হোক বা সাধারণভাবে এই পরিস্থিতির জন্য সঠিক সময়ই হোক, ঢাকা থেকে এখন যেই বার্তাটা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হলো ‘যথেষ্ট হয়েছে’। ক্ষোভের তালিকা অনেক দীর্ঘ এবং ভারতের দয়ার মুখোশ আর বাংলাদেশকে বোকা বানাতে পারবে না। অবিশ্বাস আর সন্দেহ অনেক স্পষ্ট হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দেয়ার কারণে ভারত বাংলাদেশকে তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে এসেছে। এটা স্পষ্ট যে, ভারত এটা স্বীকার করতে ব্যর্থ হয়েছে যে, পাকিস্তানকে ভাগ করে বাংলাদেশ সৃষ্টি করাটা তার নিজের স্বার্থেই করেছে এবং বাংলাদেশের প্রতি তাদের বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল কোন বদান্যতা ছিল না। এটা কোন গোপন বিষয় নয়, তা ১৯৭১ সালে ভারতের নিহত সেনাদের জন্য বাংলাদেশ যতই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করুক না কেন। ভারত এখনও ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলতেই পছন্দ করে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নয়।

দেয়া এবং নেয়া, না-কি নেয়া এবং নেয়া?

বহু বছর ধরে যে সব চুক্তি, বাণিজ্য ও বিনিময় হয়েছে, সেগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করলেই পরিস্কার বোঝা যাবে যে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের বিনিময় সবসময়ই ছিল একপক্ষীয়, এবং শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থকে মনের মধ্যে নিয়েই তারা সেই চুক্তিগুলো করেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় থাকাকালে বিষয়টা অত সহজ ছিল না, এবং সে সময় সম্পর্কটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিল্লীর জন্য আবার সুসময় আসে.. এখন পর্যন্ত সেটা চলছে।

ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি

১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ যে ঐতিহাসিক ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি হয়, তার একেবারে প্রথম অনুচ্ছেদেই রয়েছে: “প্রত্যেক পক্ষ অন্যের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান করবে, এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো থেকে বিরত থাকবে”। বাংলাদেশ তাৎক্ষণিকভাবে পার্লামেন্টে চুক্তিটার অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু ভারত সেটা করতে ৪২ বছর সময় নিয়েছে। এমনকি যখন সেটা করেছে, সেটাও করেছে ভগ্ন-হৃদয়ে এবং মানুষের চোখে ধোঁয়া দেয়ার জন্য।

বাংলাদেশের দহগ্রাম-আঙ্গুরপোতা ছিটমহলে যাওয়ার পথে যে তিন বিঘা করিডোর ছিলো, সেটি খুলে দিতে ১৮ বছর সময় নিয়েছে ভারত। ১৮৫ মিটার এই করিডোরটি মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য খোলা হতো এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর কড়া নজরদারির মধ্যে তাড়াহুড়া করে মানুষকে এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যাতায়াত করতে হতো। ভারত এমন আচরণ করেছে যে, বাংলাদেশকে তারা বিরাট সুবিধা দিয়েছে। বাস্তবতা হলো একটা অন্যায় দূর করতে তারা এত দীর্ঘ সময় নিয়েছে, যেখানে তাদের আত্মতুষ্টির বিষয়টি বোঝা যায়।

গঙ্গার পানি চুক্তি

গঙ্গার পানি চুক্তিকে ভারত আরেকটি দয়ার কাজ বলে মনে করে। ভারত-বান্ধব আওয়ামী লীগের সরকার এই চুক্তিকে তাদের মুকুটের অন্যতম পালক মনে করে। গঙ্গার পানির প্রতিশ্রুত পানি আদৌ দেয়া হয়েছে কি না, সেটা ভিন্ন বিষয়। চুক্তির পরে দুই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। মানুষ এখন পানির ন্যায্য হিস্যার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে।

তিস্তা চুক্তি নিয়ে কি বলবেন? ভারতের স্বার্থপর আচরণ আর জনগণের স্বার্থে চুক্তি করতে বাংলাদেশের ব্যর্থতার আরেকটি উদাহরণ এটা। তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে এবং এর জন্য সবকিছু প্রস্তুত ছিল। কিন্তু ভারতের ধূর্ত কৌশলকে ব্যবহার করে মনমোহন সিং আর নরেন্দ্র মোদি দুই প্রধানমন্ত্রীই মমতা ব্যানার্জির দোহাই দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সবসময় প্রচার করে এসেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের বন্ধু, কিন্তু তিস্তা কার্ডকে ব্যবহার করে নিজের রাজ্যে অবস্থান সংহত করার পাশাপাশি কেন্দ্রকেও খুশি করেছেন তিনি। মনমোহন-মোদি-মমতার জন্য এটা সবদিক থেকেই বিজয় আর বাংলাদেশের জন্য সব দিক থেকেই পরাজয়। তিস্তার পানির ব্যাপারে বাংলাদেশ যেন নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়েছে।

বাণিজ্য ও শুল্ক

বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকে থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ তাদের অর্থনীতির আকার অনেক বড়। কিন্তু এখানেও বাংলাদেশের স্বার্থকে তারা হাসিমুখ করে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশকে হয়তো তারা ক্রেডিট সুবিধার প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু এর শর্তগুলো কঠিন। বাংলাদেশের কিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা হয়তো তারা দিয়েছে, কিন্তু অশুল্ক বাধাগুলো বাংলাদেশের বাহু মুচড়ে দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা সঙ্কট

বাংলাদেশ ঘাড়ে এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিশাল বোঝা। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর তাড়িয়ে দেয়া এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা আরও বাড়ছে এবং সেটা বারতি চাপ হচ্ছে বাংলাদেশের উপর। যে এলাকায় রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে, সেই টেকনাফ আর উখিয়া এলাকার স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। তারা দেখছে তাদের জমি, সাহায্য এবং কাজ শরণার্থীদের হাতে চলে যাচ্ছে কারণ ন্যূনতম মজুরির কমেও কাজ করতে রাজি। রোহিঙ্গারা যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে আছে, তা নয়। কিন্তু এই সঙ্কটের সময়টাতে বাংলাদেশ তার ‘সত্যিকারের বন্ধু’ ভারতকে মোটেই পাশে পায়নি।

বরং ঘটেছে তার উল্টা। ভারত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পক্ষ নিয়েছে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোন আন্তর্জাতিক ফোরামেই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়নি। বাংলাদেশ ভারতের কাছে অনুরোধ করেছে যাতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে তারা এই ইস্যুটি নিরাপত্তা পরিষদে ওঠায়। কিন্তু ভারতের দিক থেকে তেমন কোন আগ্রহের ছিটেফোঁটা দেখা যায়নি। অন্যদিকে, দয়া দেখানোর অংশ হিসেবে টেবিলে কিছু রুটির টুকরো ছুড়ে দিয়ে তারা তাদের সদিচ্ছার প্রমাণ দেখাতে চেয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধান দৈনিক প্রথম আলোতে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে বিষয়টি আরও ভালোভাবে উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে আমরা পাঁচ ট্রাক খাবার দিয়েছি, এবং আরও দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি”।

ভিসা, সফর ও রাজস্ব

একই পত্রিকায় লেখা সাম্প্রতিক এক কলামে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার বিনা সিক্রি ভারতে বাংলাদেশীদের প্রবেশের অনুমতি দেয়া ক্ষেত্রে ভারতের বিশাল বদান্যতার উল্লেখ করে বলেছেন: “ভারত প্রতি বছর প্রায় ১৬ লাখ বাংলাদেশীকে ভারতে যাওয়ার জন্য ভিসা দেয়। বিশ্বের যে কোন দুই দেশের মধ্যে সম্ভবত এই সংখ্যাটা সর্বোচ্চ। ব্যবসায়, শিক্ষা, চিকিৎসা, ধর্মীয় তীর্থযাত্রা, এবং পর্যটনের জন্য ভারত তাদের পছন্দের জায়গা। এই সফরের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আকাশপথে যাতায়াতের বিষয়টি নিয়ে এখন আলোচনা চলছে, কারণ মহামারীর কারণে স্থলপথে সফর বাধাগ্রস্ত হচ্ছে”।

সিক্রি যেটা বলতে ভুলে গেছেন সেটা হলো বাংলাদেশী পর্যটকদের কাছ থেকে ভারত যে বিপুল রাজস্ব পেয়ে থাকে। চিকিৎসা, শিক্ষা বা কেনাকাটা—যেকোন ভাবেই হোক না কেন ডলার-পাউন্ডের তোড়া বাংলাদেশীদের পকেট থেকে ভারতীয় কোষাগারে গিয়ে জমা হয়। সম্প্রতি নিউমার্কেটের একজন ব্যবসায়ী ঢাকার এক নিয়মিত খদ্দেরকে ফোন করে বলেন, “দিদি, আপনারা বাংলাদেশীরা আসা বন্ধ করে দেয়ায় আমরা নি:স্ব হয়ে পড়েছি। আপনারা যা খরচ করেন তার দশ ভাগের একভাগও স্থানীয়রা [কোলকাতার লোকজন] করে না। তাই সিক্রি ও তার দেশের জনগণ সীমান্ত খুলে দিতে যে অস্থির হয়ে উঠবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

সীমান্ত হত্যা

এদিকে, ভারতের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী (বিএসএ) সীমান্তে বেসামরিক বাংলাদেশীদের হত্যা করেই চলেছে। কাঁটাতারের বেড়ার উপর ঝুলতে থাকা তরুণী ফেলানির গুলিবিদ্ধ লাশের ছবি এখনো সবার মনে খোদাই হয়ে আছে। ভারতীয় বিএসএফ তাকে হত্যা করেছে। এই নৃশংতার বিরুদ্ধে এমনকি ভারতেও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার। তারা ন্যায় বিচারের জন্য চিৎকার করছে। কিন্তু অবিচারই শক্তিশালী হয়ে বিরাজ করছে।

গত ১০ বছরে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১০০০-এর বেশি বাংলাদেশী নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার গ্রুপের হিসাবে দেখা গেছে। ভারত বলছে এটা তারা শূন্যে নামিয়ে আনবে। কিন্তু ২০২০ সালের প্রথম ৮ মাসে হত্যা করা হয়েছে ৩৯ জনকে। সাম্প্রতিক সময়ে হত্যার সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

এর জন্য ভারত কখনো ক্ষমা চায়নি। তারা এ সব হত্যাকাণ্ডকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু’ বলেই খালাস। আর আত্ম-রক্ষার্থে গুলি ছুড়তে হয়েছে বলে অযুহাত তো রয়েছেই। কোন গরীব কৃষকের গরু সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে চলে গেলে সে যদি ওটা ফিরিয়ে আনতে যায় তাহলেও কি তাকে চোরকারবারী বলবে তারা?

বাংলাদেশই ভারতের উপকার করছে

এই সম্পর্কে কেউ যদি উপকার করে থাকে সেটা বাংলাদেশ। এই কথার সঙ্গে অনেক ভারতীয় হয়তো একমত হবে না কিন্তু এর প্রমাণের অভাব নেই।

সাত রাজ্য বশীকরণ

এটা সম্ভবত ভারতের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবদান, ভারত নিজেও দীর্ঘদিন যা করতে পারেনি। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে বিদ্রোহ সফলভাবে দমন করা গেছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তারা প্রথমেই যে কাজটি করেছে তা হলো কথিত উলফা বিদ্রোহী নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দেয়া এবং বাংলাদেশে তাদের কথিত ঘাঁটিগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। নিজের মাতৃভূমিতে আশ্রয় বঞ্চিত হয়ে এসব বিদ্রোহী যদি বাংলাদেশে কোনরকম নিরাপদ আশ্রয় পেয়েও থাকে আওয়ামী লীগ সরকার তার প্রতিকার দিয়েছে ভারতকে। বিনিময়ে ভারত কি দিয়েছে? বাংলাদেশের কুখ্যাত অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়া কি বন্ধ করেছিলো? কখনোই না। কোলকাতার বিলাসবহুল বাড়িতে বসে টপ টেরররা বাংলাদেশে তাদের মাফিয়া কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। যে শান্তি বাহিনী বাংলাদেশের অনিন্দ্যসুন্দর পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি বিনষ্ট করেছিলো তাদের প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থনের কথা বাংলাদেশীরা ভুলে যায়নি।

ট্রানজিট উপহার

বিএনপি বা জাতীয় পার্টি কেউই বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজগুলোতে সহজে ও সস্তায় পণ্য পরিবহনের সুযোগ ভারতকে দেয়নি। অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি নিরাপত্তা ইস্যুগুলোও ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারতের পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত বন্ধু আওয়ামী লীগ ট্রানজিটের থালা এগিয়ে দেয়। এর জন্য ভারত কি কৃতজ্ঞ? এর প্রতিদান কি তারা দিয়েছে?

তারা বাংলাদেশকে মাত্র ১৪ মাইলের ভূখণ্ড শিলিগুড়ি করিডোর ব্যবহার করে নেপালে যেতে দেয়নি। এক তরফা বন্ধুত্বের এরচেয়ে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে?

অপমানকারী ও অহঙ্কারী

ভারতীয় কূটনীতিকরা মুখে যতই মধু ঝড়ান না কেন তাদের রাজনীতিকরাই ভারত রাষ্ট্রযন্ত্রের আসল মনোভাব প্রকাশ করেন। ভারত সরকারের পরিকল্পনা ও নীতিগুলো কোনভাবেই বন্ধুত্বের সহায়ক নয়।

ভারতের নাগরিকত্ব আইন ও আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে বাংলাভাষী ভারতীয়দের ‘বিদেশী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর তাদেরকে ‘অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী’ হিসেবে ঢোল পিটিয়ে চলেছেন রাজনীতিকরা। তারা বাংলাদেশের হিন্দুদের বলছে ‘নিপীড়িত’ সংখ্যালঘু। মনে হয় তারা একেবারেই ভুলে গেছেন যে, যখন বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হয়, গুজরাটে মুসলমানদের কচুকাটা করা হয় তখনও বাংলাদেশে পূঁজা হয়েছে এবং হিন্দু সম্প্রদায় নজিরবিহীন আড়ম্বর ও মহাসমারোহে উৎসব করেছে।

শক্তি হারিয়েছে নেকড়ে

বাংলাদেশে ক্ষোভের পাহাড় জমে উঠেছে। ভারতের কাজ ও তৎপরতার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশে জনগণ এখন কোন রাখঢাক করে না। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ যখন চীনের দিকে মুখ ফিরিয়েছে তখন চেতনা ফিরেছে ভারতের। বাংলাদেশকে হারানোর ভয় তৈরি হয়েছে। এই উদ্বেগের প্রকাশ ছিলো সম্প্রতি তড়িঘড়ি করে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব শ্রিংলার বাংলাদেশ সফর।

এই অঞ্চলের দেশগুলো আর ভারতের নেওটা নয়। ভারত তার নখরের তিক্ষ্ণতা হারিয়েছে। শ্বাদন্ত হারিয়েছে নেকড়ে। বিরাট দুষ্ট নেকড়েকে এখন আর কেউ ভয় পায় না।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ