আলী আমজদের ঘড়ি’ না মেগালিথিক

প্রকাশিত: ১০:১৮ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৭, ২০২১

আলী আমজদের ঘড়ি’ না মেগালিথিক

আব্দুল হাই আল-হাদী ঃ আলী আমজদের ঘড়ি’ না মেগালিথিক: সিলেটের উপস্থাপনে কোনটা যুক্তি যুক্ত ?
’আলী আমজদের ঘড়ি’ সিলেট শহরে অবস্থিত ঊনবিংশ শতকের একটি স্থাপনা, যা মূলত একটি বিরাটাকায় ঘড়ি। এটি একটি ঘরের চূড়ায় স্থাপিত। সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে সিলেট সদর উপজেলায় অবস্থিত এই ঘড়ির ডায়ামিটার আড়াই ফুট এবং ঘড়ির কাঁটা দুই ফুট লম্বা। যখন ঘড়ির অবাধ প্রচলন ছিল না, সেসময় অর্থাৎ ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট মহানগরীর প্রবেশদ্বার (উত্তর সুরমা) কীন ব্রিজের ডানপার্শ্বে সুরমা নদীর তীরে এই ঐতিহাসিক ঘড়িঘরটি নির্মাণ করেন সিলেটের কুলাউড়ার পৃত্থিমপাশার জমিদার আলী আহমদ খান, তার ছেলে আলী আমজদের নামকরণে। লোহার খুঁটির উপর ঢেউটিন দিয়ে সুউচ্চ গম্বুজ আকৃতির স্থাপত্যশৈলীর ঘড়িঘরটি তখন থেকেই আলী আমজদের ঘড়িঘর নামে পরিচিতি লাভ করে।
অপরদিকে, মেগালিথ হচ্ছে একপ্রকার প্রাচীন পাথর যা কোন স্থাপত্য বা মিনার তৈরী করতে এককভাবে বা অনেকগুলো নিয়ে ব্যবহৃত হয়। আর মেগালিথিক মানেই হচ্ছে এই বিশেষ প্রাচীন পাথরের তৈরী কোন স্থাপনা যা মর্টার বা কনক্রিটের ব্যবহার ছাড়াই তৈরী করা হয়েছে এবং অতি অবশ্যই যা প্রাগৈতিহাসিক বলে অভিহিত করা যায়। পরবর্তীতে নির্মিত স্থাপনাগুলোকে অবশ্য মনোলিথিক বলে অভিহিত করা যায়। মেগালিথ শব্দটা এসেছে গ্রিক “μέγας” শব্দ থেকে; মেগা মানে হল মহান, লিথ মানে পাথর যার অর্থ দাঁড়ায় “মহান পাথর”। মেগালিথের অর্থ অবশ্য এমনটাও দাঁড়ায় যে বিশেষ উদ্দেশ্যে পাথর কুঁদে নির্দিষ্ট আকৃতি দেওয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন সময়কালে মনুষ্যনির্মিত স্থাপনাকেও মেগালিথ বলে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন ধরনের বিশাল বিশাল মেগালিথ দেখা যায় যার অধিকাংশই ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয়নি। এইসব পাথরের নির্মাণ শুরু হয়েছিল নব্যপ্রস্তরযুগ- নিওলিথিক পিরিওডে (মনোলিথিক পিরিওডের প্রারম্ভাগে) এবং চলছিল তাম্র যুগ এবং ব্রোন্জ যুগ পর্যন্ত।
সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে এ ধরনের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এগুলি প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। অতীত সংস্কৃতি পুনর্গঠনে এগুলির গঠন ও স্থানভেদে বিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মেগালিথ ধ্বংসাবশেষ একমাত্র সিলেটের জৈন্তাপুরেই পাওয়া গেছে। এখানে প্রাপ্ত কাঠামোসমূহের বৈশিষ্ট্য মোটামুটিভাবে ভারতের অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির প্রায় কাছাকাছি। সিলেটের জৈন্তাপুরের মেগালিথিক স্তম্ভগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি।
সে মেগালেথিক নিদর্শনগুলো যে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের অমর কীর্তি-এ ব্যাপারে কারও কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য যে, এরকম প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন এখানে আছে। জৈন্তাপুর মেগালিথের সঠিক তারিখ নিরূপণ করা এখনও সম্ভব হয়নি, কারণ এখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খননকার্য পরিচালনা করা হয় নি, যার মাধ্যমে তারিখ জানা যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ প্রমাণ করেছেন যে, উত্তর-পূর্ব ভারতের মেগালিথ সংস্কৃতির সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেগালিথ সংস্কৃতির নিবিড় সান্নিধ্য রয়েছে। আর এটি সম্ভবপর হয়েছে অস্ট্রো-এশিয়াটিক জাতিসমূহের অভিবাসনের কারণে। এ অভিবাসন প্রক্রিয়া ইঙ্গিত দেয় যে, খাসিয়ারা নবোপলীয় যুগের শেষের দিকে এ অঞ্চলটিতে আসে। খাসিয়া পাহাড়ের মার্কোদোল প্রত্নস্থল থেকে একমাত্র কার্বন-১৪ পরীক্ষায় যে সময় পাওয়া যায় তা হচ্ছে ১২৯৬ + ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এবং একে নবোপলীয়োত্তর যুগের বলে ধরা যায়। জৈন্তাপুরের মেগালিথের চর্চা শুরু হয়েছে সম্ভবত এর সমসাময়িক যুগে অথবা সামান্য কিছু পরে। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ সালের মানুষের কীর্তি হচ্ছে জৈন্তাপুরের মেগালিথিক স্তম্ভসমূহ।
দেশ-বিদেশে সিলেটকে উপস্থাপনে জেলা প্রশাসন এক চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছেন যেটি হচ্ছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গনে প্রতিনিধিত্বশীল দর্শনীয় স্থান-স্থাপনাকে শৈল্পিক কায়দায় উপস্থাপন। সাবেক জেলা প্রশাসক জনাব রাহাত আনোয়ার এজন্য প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু যে ব্যাপারটি বারবার খটকা জাগায়, সেটি হচ্ছে-আলী আমজদের ঘড়িঘর কিংবা কীনব্রিজ সেখানে স্থান পেলেও বাংলাদেশের অনুপম সাংস্কৃতিক নিদর্শন মেগালিথিক সেখানে স্থান পায়নি। এটা ইচ্ছাকৃত না ইতিহাসের প্রতি উদাসীনতা জানিনা, তবে মেগালিথিক স্থম্ভের উপস্থিতি নিশ্চয় সিলেটের প্রাগৈতিহাসিক সময়ের সিলেটকে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে সহজেই উপস্থাপন করা সম্ভব হত। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মেগালিথিককে বিশ্বঐতিহ্যের তালিকাভূক্ত করার জন্য গুরুত্বসহকারে কাজ করছেন এবং আশা করা যায় যে খুব দ্রুতই মেগালিথিককে বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় পৃথিবীবাসি দেখতে পাবে। প্রায় ৩হাজার বছরের ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে উনবিংশ শতকের কলোনিয়াল শাসনকালের ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেখে মনে হয়, ঔপনেবিশিক মানসিকতা এখনো আমাদের নীতি-নির্ধারকদের কতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে! কীন ব্রিজ বা আলী আমজদের ঘড়ির পাশাপাশি মেগালিথিক স্তম্ভ নিশ্চয় পুরো কাজকে আরও পূর্ণতা দান করতো।
ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারের স্টোনহেঞ্জের নাম অনেকেই শুনেছেন। কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ব্যবহারকারীদের কাছে স্টোনহেঞ্জ অত্যন্ত পরিচিত জায়গা; ডেস্কটপে সবচেয়ে ব্যবহূত ছবি! স্টোনহেঞ্জের বিশালাকৃতির পাথরখণ্ডগুলোকে সোজা করে মাটিতে পুঁতে রাখা দেখে সবাই বিস্মিত হন। পাউন্ড ইউরো খরচ করে বঙ্গসন্তানদের অনেকে তা দেখতেও যান। কিন্তু ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া জৈন্তাপুরের মেগালিথিক স্তম্ভকে দেখা হয়না । জেলা প্রশাসনের নজরে অদেখাই থেকে যায়! জাতি হিসেবে এটা আমাদের দূর্ভাগ্যের অংশ বৈ কিছু নয়।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ