নাম বিভ্রাট – জৈন্তা, না জৈন্তিয়া

প্রকাশিত: ৮:৪২ অপরাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২০

নাম বিভ্রাট – জৈন্তা, না জৈন্তিয়া
  1. কয়েকদিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে  চলছে চরম বিতর্ক ।

ফেসবুকে যেহেতু নামের বিভ্রাট চলছে তাই এ বিষয়ে নিজের চিন্তা ও দায়বদ্ধতা থেকে লিখার প্রবল ইচ্ছা জন্মেছে এক কালের মেধাবী শিক্ষার্থী ফয়জুল জালাল ফয়সলের । পাঠকের জন্য  লেখা গুচ্ছ হুবহু তুলে ধরা হলো ঃ

মান্যবর পাঠকদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রশ্নঃ

প্রথম প্রশ্নটি হল- বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২৬৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১,৬২,০০০ জনসংখ্যা অধ্যুসিত সিলেট জেলার যে প্রশাসনিক এলাকা তার নাম কি?
২য় প্রশ্ন হল- সিলেটের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ ও প্রায় বারশ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে যে অঞ্চল বিস্তৃত রয়েছে আবহমান কাল থেকে তার নাম কি?
৩য় প্রশ্ন- ভোলাগঞ্জ, বিছানাকান্দি, জাফলং, লোভাছড়া- সবগুলো পর্যটন স্পট কোথায় অবস্থিত?
১ম প্রশ্নের জবাবে নিশ্চিতভাবে বলবেন জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদ।
আর ২য় ও ৩য় প্রশ্নের উত্তর হবে বৃহত্তর জৈন্তিয়া। সহজ কথা। এক সময়ের জৈন্তিয়া রাজ্য।

রাজ্যটি একসময় বিস্তৃত ছিল উত্তর দিকে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে সিলেটের কানাইঘাট ও গোলাপগঞ্জ, পূর্বে কানাইঘাট-জকিগঞ্জ এবং পশ্চিমে গোয়াইনঘাট ও সিলেট সদর উপজেলা পর্যন্ত।
মুঘল শাসন থেকে মুক্ত ছিল এ অঞ্চল। এমনকি মুঘলদের পতনের পরও ৭৮ বছর জৈন্তা রাজ্য ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন।
খাসিয়া জৈন্তিয়া পর্বতমালার বাংলাদেশ অংশে ১৮ টি পরগনা আর বর্তমান মেঘালয়ে আরও ১৮ টিসহ মোট ৩৬ টি পরগনায় বিভক্ত ছিল পুরো জৈন্তিয়া রাজ্য। রাজ্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল আকাশছোঁয়া খাসিয়া জৈন্তিয়া পর্বতমালা। আবহমানকাল থেকে এ পর্বতমালাটিই জৈন্তিয়া রাজ্যকে রেখেছিল নিরাপদ। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান স্বাধীন হলে খাসিয়া জৈন্তিয়া পর্বতমালার মেঘালয় অংশ ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় তথ্য বাতায়ন-এর ওয়েব পেইজে জৈন্তিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
“সম্ভবত জাইন্তিয়া শব্দটি খাসিয়াদের Youngteng(ইয়ংটেং) বা Youngtrai(ইয়ংট্রাই) শব্দ হতে এসেছে। খাসিয়া ভাষায় ইয়ং অর্থ ‘নিজ’ বা ‘আপন’ এবং টেং হলো কোন আদিমাতার নাম বিশেষ। Youngtengএর অর্থ হলো, ‘‘টেং- এর দেশ’’ বা আপন ভূমি। আদি জাইন্তিয়া ‘‘ইয়ান্তা’’ নামেই পরিচিত ছিল।
ইয়ান্ত শব্দটি (ইয়ংট্রাই) শব্দ হতে উৎপত্তি লাভ করতে পারে। ইয়াংট্রাই অর্থ স্বদেশ বা আদিভূমি বা নিজ ভূমি। মধ্যযুগ পর্যন্ত আ-খাসিয়াগণ জয়ন্তিয়াপুরের রাজধানী ‘জয়ন্তিয়াপুর কে’ ‘নিজ পাট’ বলে ডাকত। তাছাড়া সিন্টেং জাইন্তিয়ার আদিবাসী ‘‘পার ’’ নামে অভিহিত হতে বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। পার কথাটির অর্থ হলো নিজ। অহংকার করে নিজেকে স্বদেশের উত্তরাধিকারী বোঝাতে পার শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। পার এর অর্থবোধক শব্দ হলো আদি অধিবাসী। জাইন্তিয়ার আদিবাসীকে বোঝাতে পার- এর অ-আদিবাসীকে বুঝাতে ‘ডিখার’ বা রায়ত ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রাচীনকালে এই জাইন্তিয়াপুরের রাজধানীকে ‘জাইন্তিয়া পার বলা হতো। জাইন্তিয়া পার হতেই জাইন্তিয়াপুর বা জয়ন্তিয়াপুর অতঃপর জৈন্তাপুর নামকরণ করা হয়েছে।”
এগার’শ শতকে জয়ন্তীয়ায় কামদেব নামে অধীপতির রাজত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারত সময় কালে জয়ন্তীয়া রাজ্যের অধীশ্বরী ছিলেন প্রমীলা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বিবরণীতে বর্নিত মহাবীর অর্জুন যধিষ্টরের “অশ্ব মেধযজ্ঞে” জয়ন্তীয়া রাজ্যে এসেছিলেন। জয়ন্তীয়া রাণী প্রমীলা কর্তৃক অশ্ব মেধ বেঁধে রাখার কারণে অর্জুনের সাথে রাণীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জয়ন্তীয়া রাণী যুদ্ধে পরাজিত হলে অর্জুনের সাথে তার বিবাহ হয়।
প্রাগৈতিহাসিক রাজা গুহকের তিন পুত্র ও দুই কন্যা ছিল।
তিনপুত্রের নাম ছিল জয়ন্তক, গুড়ক ও লুডক। জয়ন্তকের নামে জয়ন্তিয়া বা জৈন্তিয়া গুড়কের নামে গৌড় এবং লুডকের নামে লাউড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। ঐ তিন রাজপুত্র তিন রাজ্য দীর্ঘদিন শাসন করেন। সুনামগঞ্জের উত্তরাংশ নিয়ে ছিল প্রাচীন লাউড় রাজ্য, মধ্য সিলেট নিয়ে ছিল প্রাচীন গৌড় রাজ্য আর উত্তর সিলেট নিয়ে বিস্তৃত ছিল জৈন্তিয়া রাজ্য। অন্য দুটি রাজ্য লাউড় ও গৌড় রাজ্য বহু আগেই হারিয়ে গেলেও জৈন্তিয়া রাজ্য বহুদিন স্বাধীন থেকে যায়। ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত জৈন্তিয়া স্বাধীন রাজ্য ছিল। গুহক রাজার দুই কন্যা শীলা ও চাতোল। বলা হয়ে থাকে রাজা গুহক তার কন্যা শীলাদেবীর নামে একটি হাট স্থাপন করেন। সেই শীলা হাটই কালের পরিক্রমায় সিলেটে পরিণত হয়।
যাই হোক এগুলো ইতিহাসের উদ্বৃতি মাত্র। আমরা যদি অতীত ইতিহাস নিয়ে সামনে আগাতে চাই তাহলে আমাদের চিন্তাকে আরো প্রসারিত করতে হবে। আমার শিক্ষাগুরু, জৈন্তিয়া কলেজের প্রাক্তণ অধ্যক্ষ শ্রদ্ধেয় নুরুজ্জামান মনি স্যারের এ বিষয়ে লিখিত কলামটা আমি একবার নয়, তিনবার পড়েছি। যৌক্তিকতার নিরিখে ইতিহাস সমৃদ্ধ এ লেখনীতে একজায়গায় স্যার উল্লেখ করেছেনঃ “আমরা সকলেই জানি, জৈন্তিয়া একটি অতি প্রাচীন সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃত। এমনকি জৈন্তিয়া অঞ্চলটি বাংলা থেকে তো বটেই, শ্রীহট্ট অঞ্চলেরও আগের।”

প্রত্যেক জাতিই অতীত স্মৃতি বুকে ধারন করে সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্মান করে। তাই অতীত স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আমরা “জৈন্তিয়া” শব্দটিই ব্যবহার করব। তাই বলে সবক্ষেত্রে নয়। প্রশাসনিকভাবে জৈন্তাপুর উপজেলার ক্ষেত্রে “জৈন্তা”- ই Appropriate. যা আমি এ লেখাটির ১ম প্রশ্নে প্রশাসনিক এলাকা হিসাবে উল্লেখ করেছি।

এবার আসি সেন্ট্রাল জৈন্তিয়া প্রসঙ্গে। উত্তরে তামাবিল স্থলবন্দর, দক্ষিণে সিলেট সদর, পূর্বে লোভাছড়া আর পশ্চিমে গোয়াইনঘাট সীমান্ত- এর কেন্দ্রই হল সেন্ট্রাল জৈন্তিয়া অর্থাৎ দরবস্ত বাজার। বৃহত্তর এই চিন্তা থেকেই এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সেন্ট্রাল জৈন্তিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে ইংরেজী central এর বাংলা “সেন্ট্রেল” হবেনা। এটা হবে “সেন্ট্রাল” অথবা “সেন্ট্র্যাল”। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে এটা সংশোধন করা যেতে পারে। এখানে কথা হচ্ছে Proper Noun এর spelling(বানান) একেকজন একেকভাবে লিখতে পারে। আপনার নামের English Spelling আপনি যেভাবে লিখেন দেশ কেন সারা বিশ্ব সেভাবে লিখতে বাধ্য। আবার কেউ বলেন শিক্ষাবোর্ডে তো জৈন্তা লিখা আছে। আমি বলি, আগে “বদলে যাও” তারপর “বদলে দাও”।
সুতরাং, আসুন ক্ষুদ্র পরিসরে চিন্তা না করে as a whole আমরা বৃহৎভাবে চিন্তা করি, জৈন্তিয়া কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদ হলে সেন্ট্রাল জৈন্তিয়া উচ্চ বিদ্যালয় অথবা জৈন্তিয়া কলেজ হবেনা কেন? প্রশাসনিকভাবে জৈন্তাপুর উপজেলা সীমানার ভিতর জৈন্তা বলি অথবা মৌখিক উচ্চারণে আমরা যা-ই বলিনা কেন বৃহত্তর জৈন্তিয়ার সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান সমুহের প্রতিষ্ঠাতা ও উপকারভোগিসহ ১২০০ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী আপামর জনসাধারণের সুবিধার্থে আমরা জৈন্তা না বলে জৈন্তিয়া-ই বলব। গৌরবময় ইতিহাসের স্মৃতি রক্ষার্থে “সেন্ট্রেল জৈন্তা” না বলে “সেন্ট্রাল জৈন্তিয়া” বলা-ই যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করি।

লেখক ঃ ফয়জুল জালাল ফয়সল
বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ