জৈন্তিয়া” নাকি “জৈন্তা” নূরুজ্জামান মনি

প্রকাশিত: ৫:২৫ অপরাহ্ণ, জুন ২৯, ২০২০

জৈন্তিয়া” নাকি “জৈন্তা” নূরুজ্জামান মনি

 

সিলেট জেলার উত্তরে অবস্থিত জৈন্তিয়া অঞ্চল নিয়ে যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে, তার সম্পূরক হিসেবে আরো কিছু বিষয় প্রাসঙ্গিক বলে আলোচনায় নিয়ে আসা জরুরি মনে করছি। অবশ্যই জৈন্তাপুর একটি প্রশাসনিক এলাকা। একটি উপজেলা। পূর্বে মোট দুইটি ইউনিয়ন নিয়ে এই উপজেলা গঠিত ছিল। বর্তমানে ইউনিয়ন বিভক্তি-সংযুক্তির পর এই উপজেলায় ইউনিয়নের সংখ্যা ছয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের দু’টি ওয়ার্ড ভাগ করে জৈন্তাপুর উপজেলার সাথে যুক্ত করা হয়। এই সংযুক্তি জৈন্তাপুর উপজেলার পরিধি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।

এই বিভক্তি-সংযুক্তির ফলে বৃহত্তর জৈন্তিয়ার কোনো অঙ্গহানি হয়নি। কোনো ভূমিই বিভক্ত-বিভাজিত হয়ে জৈন্তিয়ার বাইরে চলে যায়নি। শুধু নবগঠিত কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার সাথে গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি অংশ কেটে নেওয়ায় জৈন্তিয়ার ভৌগলিক সীমানার কিছু ক্ষতি সাধিত হয়। কিন্তু ঐ কর্তিত অংশের অধিবাসীরা এখনো নিজেদের জৈন্তিয়াপুরী পরিচয় দিয়েই গর্ববোধ করে।
আমরা মনে করি বৃহত্তর জৈন্তিয়া নামে ইতিহাসখ্যাত এই অঞ্চলের ঐক্য-সংহতি বহাল রাখতে কারো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। জৈন্তাপুর একটি প্রশাসনিক অঞ্চল আর জৈন্তিয়া একটি বৃহত্তর পরিধি। এই পরিধির ঐক্যের মধ্যে ভবিষ্যত সম্ভাবনার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। আমরা জানি কোনো নির্বাচনী এলাকা কিংবা প্রশাসনিক জেলা ও স্থানীয় সরকারের অধীন ইউনিয়ন পরিষদ বিভাজন ভৌগলিক সীমারেখার ভিত্তিতে নয়, জনসংখ্যার অনুপাতে হয়। তাই যদি কখনো নতুন জেলা গঠনের প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে, তবে অবশ্যই ঐতিহ্যবাহী জৈন্তিয়াকে জেলা করার দাবি অগ্রগণ্য হবে। সেজন্য বৃহত্তর জৈন্তিয়ার ঐক্য বজায় রাখতে সবার সর্বাত্মক আন্তরিক উদ্যোগ থাকা আবশ্যক।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, যে কোনো জাতি-সম্প্রদায় কিংবা কোনো অঞ্চলের পরিচয় ধরে রাখার স্বার্থে তার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন-সংরক্ষণ অবশ্য কর্তব্য। কেননা ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি একটি জাতি-সম্প্রদায় কিংবা একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়। যে জাতি-গোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য যত বর্ণিল, সে জাতি তত সমৃদ্ধ। বৃহত্তর জৈন্তিয়ার সেই সমৃদ্ধ-বর্ণিল ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। জৈন্তিয়াবাসীর আপন উদাসীনতায় তা বিস্মৃত-বিলুপ্ত হতে চলেছে। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

প্রাচীন জৈন্তিয়া রাজ্য নিয়ে ইতিহাসের বাইরেও অনেক কিংবদন্তি-উপকথা-কল্পকাহিনী ছড়িয়ে আছে। কিংবদন্তি-উপকথা-কল্পকাহিনী অবশ্যই ইতিহাস নয়। কিন্তু ইতিহাসের সহায়ক উপাদান। এগুলো গড়ে ওঠে ইতিহাসের কোনো ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ ঘটনার উপর ভিত্তি করে। একটি লোহার টুকরো অবহেলায় ফেলে রাখলে দিনে দিনে তার উপর শ্যাওলা-ময়লা জমে জমে অনেক বড় বস্তুর আকার ধারণ করে। একসময় সেই লোহার খণ্ডটুকুর অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের টুকরো-টাকরার মধ্যেও তেমনি কিংবদন্তিরূপ শ্যাওলা-ময়লা জমে। মূল ইতিহাসটাকেই আর খুঁজে পাওয়া শ্রমসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু নজরে খুঁজলে অবশ্যই সেই ইতিহাসের সন্ধান মেলে।

জৈন্তিয়াকে ঘিরে সেইরকম অনেক কিংবদন্তি-উপকথা রচিত হয়েছে। অবশ্যই এইসবের মূলে ক্ষীণ হলেও ইতিহাসের সত্য উপস্থিত। উদাহরণস্বরূপ মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবের মধ্যে সংঘটিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে জৈন্তিয়া রাজ্যের উল্লেখ পাই। পঞ্চ-পাণ্ডব প্রধান অর্জুনের অশ্বমেধযজ্ঞের অশ্ব জৈন্তিয়া রাজ্যের রাণী প্রমীলার হাতে ধৃত হয়। অর্জুন তার অশ্ব উদ্ধারের উদ্দেশ্যে জৈন্তিয়ায় এসে রাণীর সাথে সন্ধিচুক্তি করে অশ্ব ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হন ।এরপর অর্জুন এখান থেকে মণিপুরের দিকে চলে যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে মণিপুর রাজ্যের রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রসিদ্ধ “চিত্রাঙ্গদা” নৃত্যনাট্যটি সেই প্রেমকাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, রবীন্দ্রনাথ সিলেট সফরে এলে মাছিমপুরে গিয়ে স্থানীয় মণিপুরী নৃত্য দেখে এই অভিনব নৃত্যকলায় মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্যের চর্চা শুরু করেন। চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যেও মণিপুরী নৃত্য প্রবর্তন করেন।

এছাড়া অহম রাজ, কাছাড় রাজ, কোচ রাজসহ মোঘল ও ব্রিটিশদের সাথে অনেক সংঘাত-সম্প্রীতির ঘটনা বহু ইতিহাসবিদের বিবরণে পাওয়া যায়। সেই সব বিবরণ থেকে জানা যায়, জৈন্তিয়া সে সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-সম্পদে ভরপুর ছিল। বিশেষত পাহাড়ের চূণাপাথর, তেজপাতা, সুগন্ধি আগর ও কাঠের জন্য সবার নজর এই অঞ্চলের উপর ছিল। তাই বারবার জৈন্তিয়া বহু বহিঃশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। জৈন্তিয়ার রাজারা দক্ষতার সাথে সকল আক্রমণ মোকাবেলা করে জৈন্তিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন।

আমরা জানি, প্রাচীনকালে জৈন্তিয়া অনেক বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। ৪৭ এর দেশভাগের পর ভারতের অংশে অবস্থিত জৈন্তিয়ার আঠারো পরগণা আসামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তখন আসাম পশ্চিমে রংপুরের কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরে আসাম রাজ্য বিভক্ত হয়ে পশ্চিমাংশ নিয়ে মেঘালয় রাজ্য গঠিত হয়। জৈন্তিয়া হিল ডিস্ট্রিক্ট সেই দীর্ঘ ইতিহাসেরই সাক্ষ্য বহন করে। বর্তমানে ইস্ট ও ওয়েস্ট জৈন্তিয়া হিল ডিস্ট্রিক্ট নামে দুটি প্রশাসনিক ডিস্ট্রিক্ট রূপে বিভক্ত হয়ে আজো সেই ইতিহাসকে ধারণ করে চলেছে।

প্রাচীন শ্রীহট্ট তথা বর্তমান সিলেটের গৌড় ও লাউড় রাজ্যের অস্তিত্ব কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও জৈন্তিয়া রাজ্য এখনও স্বনামেই বিরাজমান। গৌড় কিংবা লাউড়ের রাজ্য পরিচালনার ঐতিহাসিক কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও জৈন্তিয়ার রাজাদের শাসনকাল ও তাদের নাম-বংশপরিচয় প্রাচীন দলিলাদি ঘাটলে পাওয়া যায়। এমনকি তখনকার প্রচলিত মুদ্রার ছাপও আমাদের হাতে এসেছে। জৈন্তিয়ায় সেসময় ধাতব রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ছিল। মুদ্রাগুলোর উপর লেখাগুলো দুর্বোধ্যই বলা যায়। ইতিহাসবিদরা বলছেন, মুদ্রাগুলোর দু’পিঠের লেখা প্রাচীন দেবনাগরী ভাষায় লিখিত।

সর্বশেষ ব্রিটিশরা তাদের এক ব্যক্তিকে নরবলি দেওয়ার অভিযোগ এনে জৈন্তিয়াকে দখলে নিতে উদ্যোগী হয়। মুখোমুখি যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না জেনে প্রতারণার মাধ্যমে জৈন্তিয়ায় ঢুকে কৌশলে জৈন্তিয়ার শেষ রাজা ইন্দ্র সিং মতান্তরে রাজেন্দ্র সিংকে বন্দি করতে সমর্থ হয়। পরাজিত রাজা ইন্দ্র সিংকে ধরে এনে সিলেটের রায়নগরে মুরারীচাঁদ রায়ের বাড়িতে বন্দি করে রাখে। তাকে মাসিক ভাতা হিসেবে পাঁচশত টাকা ধার্য করে। একটি কবিতার পংক্তিতে এর প্রমাণ এরকম,

বাট্টি মুট্টি ইন্দ্র সিং মুখে রেখ দাড়ি
বন্দী করি’ থইল নিয়া’ মুরারীচান্দর বাড়ি।

সিলেটের এক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে আমি জৈন্তিয়ার রাজা ইন্দ্র সিংহের নিজ হাতে লেখা একটি পত্রের কপি উদ্ধার করেছিলাম। পরে সেই পত্রটি সিলেটের একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশও করেছিলাম। জৈন্তিয়ার বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ লেখক শ্রদ্ধেয় ফজলুর রহমানের সাথে আমি এই পত্র নিয়ে আলোচনা করি। তিনি আমাকে এই পত্রের সত্যতা নিশ্চিত করেন। বন্দি রাজা দরবস্তের এক স্থানীয় জমিদারের কাছে সেই পত্রটি লেখেন। অত্যন্ত অনুনয় করে রাজা লেখেন, পাঁচশত টাকা ভাতায় তার মাস চলে না। তাকে কিছু অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করতে জৈন্তিয়াবাসীর প্রতি অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধ রক্ষার্থে জৈন্তিয়ার সতেরো পরগনার মুরব্বীরা সমবেত হয়ে তাদের প্রিয় রাজার দুর্দিনে পাশে দাঁড়াতে উদ্যোগী হন। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে জৈন্তিয়া রাজার বাড়ির আঙিনায় সাপ্তাহিক হাট বসান। এই হাট থেকে সংগৃহীত রাজস্বের পুরোটাই রাজার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জৈন্তিয়ার সকল মানুষকে বাজারে এসে কেনাকাটা করতে অনুরোধ করা হয়। সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্থাপিত জৈন্তিয়ার বাজার এখনও রাজবাড়ির আঙিনায় চলছে। যদিও সেই প্রাচীন রাজবাড়ির অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে।

পরিশেষে বলি, জৈন্তাপুর হলো এই প্রাচীন রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। বৃহত্তর জৈন্তিয়ার কেন্দ্র আর জৈন্তিয়া হলো পরিধি। তাই ঐতিহ্য-ইতিহাস সংরক্ষণের স্বার্থে যে কোনো মূল্যে বৃহত্তর জৈন্তিয়ার ঐক্য-সংহতি সুরক্ষা করা সময়ের দাবি। নাহলে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ জৈন্তিয়ার ভবিষ্যৎ দুর্ভাগ্যের ঘূর্ণিপাকে পতিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

২৯/০৬ /২০
ম্যানচেস্টার
ইউকে
রৌপ্যমুদ্রার ছবি সংগৃহীত।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ